ভর্তি পরীক্ষায় ২৫৩তম হয়েও ঝাপসা আল আমিনের দুনিয়া
চাঁদপুরের আল আমিন গাজী। লঞ্চে ফিরছেন বাড়ি। ঢাকায় এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটের (ব্যবসায় অনুষদ) ভর্তি পরীক্ষার ফল জানতে। কেমন হয়েছে ফলাফল? শুকনো গলায় জবাব এলো, ‘হ্যাঁ, মেধাতালিকায় ২৫৩তম।’ বলেন কি! কোথায় বলুন তো? আবারও শুকনো গলায় জবাব, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রতিটা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছেন এর পরেও এমন বিমর্ষ কেন? আল আমিন গাজী বিমর্ষ মুখটা তুলে ধরেন। এবারও জবাব এলো বিমর্ষ সুরে, ‘সুযোগ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু ভর্তি তো হতে হবে? ভর্তির টাকা নেই আমার কাছে। আমার বাবার কাছেও নেই।’
আল আমিন গাজীর সঙ্গে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলাপ হলো। বাবা বাবুল গাজী অটোরিকশা চালান। একসময় রিকশা চালাতেন। দিনে ৪০০-৫০০ টাকা আয় করেন তিনি। ঋণ নেওয়ার কারণে মাসে কিস্তি দিতে হয় ১০-১২ হাজার টাকা। ছোট বোনটা এবারই জেএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। কোনোমতে চলছে সংসার।
‘এ অবস্থায় আমার মনে হয় না আমি ভর্তির টাকাটা জোগাড় করতে পারব। চোখে ঝাপসা দেখছি। প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটার চেহারাও ঝাপসা লাগছে,’ বলেন আল আমিন।
এ পর্যন্ত এলেন কীভাবে? আল আমিন গাজী জানালেন, চাঁদপুর হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেছেন। বললেন, ‘আমি প্রাইভেট পড়তে পারিনি কখনো। ওই টাকা আমাদের নেই। এসএসসি পরীক্ষায় ৪.৮৮ পেয়েছি।’
এরপর কলেজে প্রবেশ। আল আমিন বলেন, ‘ভর্তি হই চাঁদপুর সরকারি কলেজে। কলেজের শিক্ষক সাজ্জাদ হোসাইন আমাকে বিনামূল্যে হিসাববিজ্ঞান পড়াতেন। আর কোনো স্যারের কাছে পড়ার সুযোগ হয়নি। এইচএসসিতে পেলাম ৪.৫৮। আশানুরূপ ফল না পেয়ে মন ভেঙে গেল। আমার মামা মোহাম্মাদ সুমন মিয়াজি আমার বাসায় গিয়ে দেখলেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করি না। তখন তিনি আমাকে ঢাকার সেগুনবাগিচায় তাঁর বাসায় নিয়ে আসলেন এবং ভর্তি করে দিলেন একটি কোচিং-এ। চলতে থাকল আমার পথচলা।’
আল আমিন বলেন, ‘যথারীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হলো ১৬ অক্টোবর। ১৮ অক্টোবর ফলাফল ঘোষণা। মোবাইলে প্রথমবার যখন ফলাফল দেখলাম তখনো প্রকাশিত হয়নি। তারপর নামাজ আদায় করে দেখলাম আমি চান্স পেয়েছি। মেধাক্রম ২৫৩ এবং স্কোর ১৬৮.৯২। স্বপ্নও তাহলে সত্যি হয়? আর এটা মনে হওয়ার কারণ এইচএসসিতে আমার কাঙ্ক্ষিত ফল আমি পাইনি। বলতে গেলে কখনোই আমার স্বপ্ন এভাবে সত্যি হয়নি। তা ছাড়া পেছনে ফেলে আসা দুঃখ, কষ্ট ও দারিদ্র্যের ভয়াবহতা আমাকে অনেক কিছু মনে করিয়ে দিল। এই চান্স পাওয়ার পর মনে হলো আমি নতুন একটা পথ দেখলাম। কিন্তু এখনো অনেক পথচলা বাকি। এই পথচলা যখন শেষ হবে তখন আমি বিসিএস ক্যাডারে শিক্ষা বিভাগে হিসাববিজ্ঞানে শিক্ষকতা করব।’
এত বড় স্বপ্ন। এর পেছনে এত ছুটে চলা, এরপরও কেন দুঃস্বপ্ন? এবারও শুকনা গলায় উত্তর দিলেন আল আমিন। ‘সংসার চালানোর খরচ, কিস্তি মেটানোর পর আর কিছুই থাকে না। ভর্তির টাকা কীভাবে আসবে? বাবার পক্ষে তা দেওয়া অসম্ভব।’
লঞ্চটা ধীরে ধীরে ঢাকা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তেমনি স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও দূরে সরে যাচ্ছেন আল আমিন গাজী। কয়েকটা মাত্র দিন আছে। অপেক্ষা করছেন হয়তো স্বপ্ন পূরণ হবে কোনোভাবে।