প্রাথমিকেই ঝরে পড়ছে লালমনিরহাটের চরাঞ্চলের শিশুরা

লালমনিরহাটের চরাঞ্চলের বেশিরভাগ শিশুই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। প্রাথমিকের গণ্ডিই পেরোতে পারছে না অনেকে। প্রাথমিকে ঝরে পড়া শিশুরা আবার যুক্ত হচ্ছে শিশুশ্রমে। সম্প্রতি জেলার আদিতমারি উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের গোবর্ধন চরে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়ন। তিস্তা নদীবেষ্টিত এ ইউনিয়নের অল্প কিছু শিক্ষার্থী প্রতিদিন নদী পার হয়ে এসে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। আর বাকি শিশুরা চরাঞ্চলের ফসলি জমিতে কাজে নিয়োজিত।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, গোবর্ধন চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৭ জন, গোবর্ধন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০ জন, গোবর্ধনহাট ইসমাইলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫ জন এবং গোবর্ধন ইসমাইলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৮ জন।
প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতেই নানা চড়াই-উতরাই পার হতে হয় এই চরের অধিকাংশ শিশুকে। এখানে শুষ্ক মৌসুমে বালুময় প্রান্তর। আর বর্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চলাচলই একমাত্র মাধ্যম। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব, পরিবারের অভাব-অনটনসহ নানা কারণে মাঝপথেই বন্ধ হচ্ছে অনেকের পড়াশোনা। নিজ এলাকায় বিদ্যালয় না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। তাই নিজ এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি স্থানীয়দের।
তিস্তার চরে কাজ করতে যাওয়া এরশাদুল ইসলাম (৮) বলে, ‘বাবার সঙ্গে তামাক বাড়িতে (তামাক ক্ষেতে) কাজ করছি। রাস্তা ভালো নেই, অনেকদূর যেতে হয়। তাই স্কুল যাই না। এখানে স্কুল থাকলে আমি নিয়মিত পড়াশোনা করতাম।’
গোবর্ধন চড় এলাকার পেয়ারুল ইসলাম (৪২) বলেন, ‘এখানে ছয় মাস খরা আর ছয় মাস বন্যা হয়। খরার সময় হেঁটে বালি পার হয়ে স্কুলে যেতে বাচ্চাদের কষ্ট হয়। আমাদের এখানে একটা স্কুল থাকলে ভালো হতো।’
গোবর্ধন চড় এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য মো. জমির আলী বলেন, ‘দূরত্ব বেশি হওয়া ও যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে এই চরের শিশুরা স্কুলে যেতে চায় না। শিশুর সুশিক্ষা নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব সরকারের। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে অনুরোধ করব এখানে একটি স্কুল স্থাপন করার জন্য। স্কুল স্থাপন সময় সাপেক্ষ হলে আপাতত প্রি-প্রাইমারি শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে আগামীতে এ এলাকার বৃহৎ সংখ্যক শিশু শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকবে।’
গোবর্ধন চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. রোবায়দা বেগম বলেন, বন্যার সময় শিশুরা নদীর ওপারে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লাসের সময় অতিক্রম হয়ে যায়। অনেক সময় শিক্ষার্থীদের বই পানিতে ভিজে যায়। ঝুঁকি মনে করে অভিভাবকেরা শিশুদের স্কুলে পাঠাতে চায় না। ফলে শিশুরা প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ে শিশুশ্রমে ধাবিত হচ্ছে।
সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য ও সিনিয়র সাংবাদিক আবু হাসনাত রানা বলেন, দূর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থাই চরাঞ্চলের শিশুদের উন্নয়নে প্রধান বাধা। চরাঞ্চলের এই শিশুদের মূল ধারায় আনার দ্বায়িত্ব সরকারের। স্কুল স্থাপন সময় সাপেক্ষ হলেও বিকল্প ব্যবস্থায় চরের শিশুদের পাঠদান জরুরি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার লিটন দাস বলেন, ‘নদীর ওপার থেকে অনেক শিক্ষার্থী এপারের স্কুলে অনেক কষ্ট করে আসে। এদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এপারে আসা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সে হিসেবে নদীর ওপারে প্রাক প্রাথমিক ও শিশু শ্রেণির জন্য যদি কোনো কেন্দ্র করা যায় তাহলে ওখানকার শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবে না। এ ব্যাপারে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’