চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই বছর শেষ করছে নির্বাচন কমিশন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন যেদিন শপথ গ্রহণ করেন সেদিন সিইসি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ সেটা আমরা এখনও বুঝে উঠিনি। চারদিকে তাকিয়ে বুঝব, আসলে কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কিনা। সেভাবেই দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল গড়ে তুলব।’ তখন না বুঝলেও এখন এ সিইসি খুব ভালোভাবে বুঝে গেছেন, তাদের সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল যত শেষের দিকে গড়াতে থাকে, ইসির সামনে তত নানামুখী চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হতে থাকে। একদিকে মাঠের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ সরকার বিরোধী জোটগুলোর ভোটে অংশগ্রহণ করানোর চ্যালেঞ্জ শুরু হয়। শেষমেশ তাদের ভোটে আনতে পারেনি ইসি। অন্যদিকে বিদেশিদের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, দেশের অনেক বিশিষ্ট নাগরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না মর্মে বারবার কথা বলেছেন। আর গত দুই সংসদ নির্বাচনে মানুষের ভোট বিমুখতার পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনার চাপ তো রয়েছেই।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারে রয়েছে। আর সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি। এ নির্বাচন কতটা এক তরফা হচ্ছে, তা বোঝা যায় জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রসঙ্গে চোখ রাখলে। এই অবস্থায় অধিকাংশ সংসদীয় আসনেই আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ পথ উন্মুক্ত করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন এমন সব প্রার্থীদের সঙ্গে গণভবনে মতবিনিময়কালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া ঠেকাতে বিকল্প (ডামি) প্রার্থী রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপ প্রয়োগ না করতেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নির্দেশ দিয়েছেন।
এই যখন অবস্থা, তখন চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘আমাদের নির্বাচনে কিন্তু বাইরে (বিদেশ) থেকেও থাবা, হাত এসে পড়েছে। তারা থাবা বিস্তার করে রেখেছে। দেশের অর্থনীতি, ভবিষ্যৎসহ অনেক কিছু রক্ষা করতে হলে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে।’
বিদেশ থেকেও থাবা বা হাত এসে পড়েছে, এর অর্থ হলো দেশের ভেতরের চাপও রয়েছে এ জাতীয় নির্বাচনের ওপর।
গত এক বছর ধরে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সহযোগী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকার বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়, সে ব্যাপারে অংশীজনদের তাগাদা দিয়েছেন বারংবার। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাধর এ রাষ্ট্রটির পক্ষ থেকেও বারবার একই তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘোষণা করা হয়েছে ভিসা নীতিও। বলা হয়েছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে; এমন ব্যক্তিদের ওপর এ ভিসানীতি কার্যকর করা হবে। সব মিলিয়ে দেশটি চায়, জনগণ যেন ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ পায়।
চারদিকের আলোচনা, ভোটের অধিকারের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনীতিকরা দ্বিধা-বিভক্ত। দেশে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ। আইনের শাসন ও মানবাধিকারের ঘাটতির প্রশ্ন জোরালো। এসব নিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার অনেক দেশ কথা বলছে। বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিয়েও কথা বলছে উন্নয়ন অংশীদার কয়েকটি দেশ। এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন না হলে নানাভাবে বাংলাদেশ বিপদে পড়তে পারে বলে অশঙ্কা অনেকের। সেজন্যই হয়তো সিইসি বলেছিলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি, আমাদের ভবিষ্যৎ, পোশাক শিল্পসহ অনেক কিছুই রক্ষা করতে হলে এই নির্বাচনটাকে ফ্রি, ফেয়ার এবং ক্রেডিবল করতে হবে।’
দিন গড়ায়, আর ইসির চ্যালেঞ্জ যেন বাড়তে থাকে। নির্বাচন বর্জন করে তা আবার ঠেকানোর চেষ্টা করছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। ডাক দিয়েছে অসহযোগ আন্দোলনের। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তার ওপর বিভিন্ন আসনে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অনেক এলাকায় দুপক্ষের রেষারেষি সংঘাতে রূপ নিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের ঘটনা বাড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনি কার্যক্রম সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সব বাধা অতিক্রম করে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
ইসির এই অতিরিক্ত সচিব এনটিভি অনলাইনকে বলেন, অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেষ করতে যাওয়া বছর ২০২৩। দেখা যাক, সামনের বছরের ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন কেমন হয়।