আমি মালালা বলছি
বুদ্ধিমানদের ক্লাস
এই অন্ধকার দিনগুলোতে শুধু স্কুলের জন্যই আমি বাইরে যেতাম। রাস্তায় চলার সময় মনে হতো, প্রত্যেক লোকই একেজন তালিব। আমরা আমাদের চাদরের নিচে স্কুলব্যাগ ও বই লুকিয়ে রাখতাম। বাবা সব সময়ই বলতেন, সকালে গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো স্কুলের ইউনিফর্ম পরা শিশু, কিন্তু এখন আমরা সেগুলো পরতে ভয় পাই।
আমরা হাই স্কুলে উঠে গিয়েছিলাম। ম্যাডাম মারিয়াম বললেন যে আমরা বেশি প্রশ্ন করি, তাই কেউ আমাদের ক্লাস নিতে চায় না। বুদ্ধিমতী হিসেবে পরিচয় পাওয়াটা আমাদের ভালোই লাগত। ছুটি বা বিয়েতে হাতে মেহেদি লাগালে আমরা ফুল-প্রজাপতির বদলে ক্যালকুলাস এবং রসায়নের সূত্র আঁকতাম। মালকা-ই-নূরের সঙ্গে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতেই থাকল, কিন্তু সে প্রথম আসার পরই তার দ্বারা পরাস্ত হওয়ার ধবলি কাটানোর পরই আমি পরিশ্রম করতে শুরু করলাম এবং ক্লাসে প্রথম হয়ে স্কুলের অনার্স বোর্ডে আমার স্থান পুনরুদ্ধার করতে পারলাম। সে সাধারণত দ্বিতীয় হতো এবং মনিবা হতো তৃতীয়। শিক্ষক-পরীক্ষকরা প্রথমে দেখত কত বেশি লিখেছি, এর পর দেখত উপস্থাপন শৈলী। আমাদের তিনজনের মধ্যে মনিবার লেখা এবং উপস্থাপনই সবচেয়ে সুন্দর ছিল। কিন্তু আমি সব সময় বলতাম, সে নিজেকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে না। সে পরিশ্রম করত, কারণ কম নম্বর পেলে পুরুষ আত্মীয়রা তার পড়ালেখা বন্ধ করার অজুহাত হিসেবে এটা ব্যবহার করবে। আমি অঙ্কে সবচেয়ে দুর্বল ছিলাম, একটা পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছিলাম, কিন্তু আমি কঠিন পরিশ্রম করলাম। আমার রসায়ন শিক্ষক ওবায়দুল্লাহ স্যার (আমরা শিক্ষকদের স্যার বা মিস বলে ডাকি) বললেন যে আমি জন্মগতভাবেই রাজনীতিবিদ, কারণ মৌখিক পরীক্ষার আগে আমি সব সময়ই বলতাম, ‘স্যার, আমি বলতে পারি আপনিই সেরা শিক্ষক এবং আপনার ক্লাসটাই আমার সবচেয়ে পছন্দ।’
কোনো কোনো অভিভাবক নালিশ করলেন যে স্কুলটা আমার বাবার হওয়ায় আমার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছিল, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও আমাদের সবার ভালো বন্ধুত্ব এবং ঈর্ষাবিহীন মনোভাব দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত। আমরা বোর্ড পরীক্ষায়ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতাম। এই পরীক্ষায় সব জেলার প্রাইভেট স্কুলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হতো এবং এক বছর আমি মালকা-ই-নূর হুবহু একই মার্কস পেলাম। কে পুরস্কার পাবে, দেখার জন্য আমরা স্কুলে আরেকটা পেপার করলাম এবং আবারও একই নম্বর পেলাম। মানুষ যাতে মনে না করে, আমি বিশেষ সুবিধা পাচ্ছি; সে জন্য বাবা তাঁর বন্ধু আহমাদ শাহর স্কুলে পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। আবার আমরা একই মার্কস পেলাম, তাই দুজনই পুরস্কার পেলাম।
কাজ ছাড়াও স্কুলে অনেক কিছু করার ছিল। আমরা নাটক করতে পছন্দ করতাম। দুর্নীতি বিষয়ে আমি রোমিও ও জুলিয়েটের ওপর ভিত্তি করে একটি স্কেচ লিখলাম। আমি দেখালাম, রোমিও হলো মানুষকে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া এক সরকারি কর্মচারী। প্রথম প্রার্থী এক সুন্দরী মেয়ে এবং সে তাকে অনেক সহজ সহজ প্রশ্ন করে, যেমন, ‘বাইসাইকেলে কয়টি চাকা থাকে?’ ‘দুইট,’ বলে মেয়েটি উত্তর দিলে সে বলে, ‘আপনি দুর্দান্ত মেধাবী।’ পরবর্তী প্রার্থী পুরষ হওয়ায় রোমিও তাকে অসম্ভব সব প্রশ্ন করে, যেমন, ‘চেয়ার থেকে না উঠেই ওপরের ফ্যানটি তৈরির কৌশল বলুন।’ প্রার্থী জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কি আমার পক্ষে জানা সম্ভব?’ রোমিও বলে, ‘আপনি বলছেন আপনার পিএইচডি ডিগ্রি আছে আর আপনি এটাই জানেন না।’ রোমিও মেয়েটাকে চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মেয়ের ভূমিকা অবশ্যই মনিবাকে দেওয়া হলো এবং তার মজাদার উক্তিগুলোর সঙ্গে কিছু লবণ, মরিচ ও মসলা যোগ করার জন্য, আতিয়া নামের আমাদের আরেক সহপাঠী আমার সহকারীর চরিত্রের অভিনয় করল। সবাই প্রচুর হাসল। আমি মানুষকে অনুকরণ করতে ভালোবাসতাম এবং বিরতির সময় বন্ধুরা আমাকে শিক্ষকদের বিশেষত ওবায়দুল্লাহ্ স্যারের অভিনয় করে দেখাতে অনুরোধ করত। এই খারাপ খারাপ ঘটনার মধ্যে হাসির জন্য ছোট ছোট কারণও প্রয়োজন ছিল।
২০০৭-এর শেষদিকে আর্মি অ্যাকশনও তালেবানকে তাড়াতে পারেনি। আর্মি সোয়াতে থাকত এবং এখন শহরের সব তাড়াতে পারেনি। আর্মি সোয়াতে থাকত এবং এখন শহরের সব জায়গায় থাকে, তবু ফজলুল্লাহ প্রতিদিন তার রেডিও সম্প্রচার করে যেতে থাকল এবং ২০০৮ সাল পুরোটা জুড়ে অবস্থা বোমা বিস্ফোরণ এবং হত্যাযজ্ঞের আগের অবস্থার চেয়ে খারাপ হয়ে থাকল। ওই সব দিনে আমরা শুধু সেনাবাহিনী এবং তালেবান নিয়েই কথা বলতাম, এবং বলতাম আমরা এই দুইয়ের মাঝে আটকে গেছি। ‘তালেবান ভালো, সেনাবাহিনী ভালো না’ বলে আতিয়া আমাকে ক্ষ্যাপাত। আমি জবাব দিতাম, ‘যদি একটা সিংহ আর একটা সাপ আমাদের আক্রমণ করতে আসে আমরা কি সিংহটাকে ভালো বলব, নাকি সাপটাকে?’
আশপাশের ত্রাসের রাজত্বের তুলনায় স্কুলটা ছিল স্বর্গ। আমার ক্লাসের অন্য সব মেয়ে ডাক্তার হতে চাইত, কিন্তু আমি আবিষ্কারক হয়ে তালেবানের বন্দুক কেড়ে নিয়ে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘অ্যান্টিতালেবান মেশিন’ আবিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অবশ্য স্কুলেও আমরা হুমকির মুখে ছিলাম এবং আমার কিছু বন্ধু ঝরে পড়ল। ফজলুল্লাহ মেয়েদের ঘরে বসে থাকার নির্দেশ সম্প্রচার করে যেতেই থাকল এবং বাচ্চারা না থাকত সময়ে রাতের বেলা কারফিউর সময় তার লোকেরা স্কুল উড়িয়ে দিতে থাকল।
মাত্তায় অবস্থিত মেয়েদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শাওয়ার জাঙ্গে ছিল উড়িয়ে দেওয়া প্রথম স্কুল, এমন কাজ কেউ করতে পারে, এটা আমাদের বিশ্বাসই হলো না। প্রায় প্রতিদিনই বোমা হামলা হতে থাকল, এমনকি মিঙ্গোরাতেও বিস্ফোরণ হলো। আমি রান্নাঘরে ছিলাম সময়ে দুবার বোমা ফাটল, এতই কাছে যে পুরো বাড়ি ঝনঝনিয়ে উঠল এবং জানালার ওপরের ফ্যানটা পড়ে গেল। আমি রান্নাঘরে যেতে খুবই ভয় পেতাম, শুধু দৌড়ে ঢুকতাম আর বেরোতাম।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিন আমি রান্নাঘর থেকে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম। কান ফাটানো শব্দ হয়েছিল এবং অবশ্যই খুব কাছে। অন্য সময়ের মতো সবাই নিরাপদে আছি কি না, তা বুঝতে একে অপরের নাম ধরে ডাকলাম। ‘খাইস্তা, পিশো, ভাবি, খুশাল, অতল।’ আমরা একের পর এক সাইরেনের শব্দ শুনলাম, যেন মিঙ্গোরার অ্যাম্বুলেন্সগুলো যাচ্ছে। এক আত্মঘাতী বোমারু হাজি বাবা হাইস্কুলের বাস্কেটবল কোর্টে হামলা করেছে। জাভেদ ইকবাল নামের এক জনপ্রিয় স্থানীয় পুলিশ অফিসারের জানাজার কাজ চলছিল, যিনি তালেবানের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় এক দুর্গম এলাকায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। তিনি মিঙ্গোরার লোক, এবং তার দেহ জানাজা ও পুলিশ স্যালুটের জন্য ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। আর এখন তালেবান শোকার্তদের হামলা করল। জাভেদ ইকবালের ছোট ছেলে এবং আমাদের পরিচিত অনেক মানুষসহ ৫৫ জনের বেশি মানুষ মারা গেল। মনিরার পরিবারের ১০ জন সদস্য হতাহত হলো। মনিরা বিধ্বস্ত প্রায়, পুরো শহর হতবিহ্বল। সব মসজিদেই সান্ত্বনাবাণী ছিল।
‘তুমি এখন ভয় পাচ্ছ?’ আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। ‘জানি, রাতে আমাদের ভয় থাকে প্রবল, ‘বাবা আমাকে বলেন, ‘কিন্তু সকালে আলো ফুটলে আমরা সাহস ফিরে পাই।’ এবং আমার পরিবারের জন্য এটা সত্য। আমরা ভীত, কিন্তু ভয়টা আমাদের সাহসের মতো শক্তিশালী না। ‘আমাদের উপত্যকাকে অবশ্যই তালেবানমুক্ত করতে হবে, তাহলেই কাউকে এই ভয় পেতে হবে না’, তিনি বললেন।
সংকটকালে আমরা পশতুনরা পুরোনো বিশ্বাসে ফিরে যাই, তাই ২০০৮ সালে সোয়াতের মুরব্বিরা ফজলুল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করতে কওমি জিরগা নামের একটি সংগঠন তৈরি করে। মুখতার খান ইউসুফজাই, খুরশিদ কাকাজী এবং জাহিদ খান নামের তিন স্থানীয় ব্যক্তি হুজরা থেকে হুজরায় গিয়ে মুরব্বিদের যোগ দিতে অনুরোধ করতে লাগলেন। বড় মুরব্বি ছিলেন সাদা-দাড়িওয়ালা চুয়াত্তর বছর বয়সী আবদুল খান খালিক, রানি সোয়াতে আমাদের ওয়ালির সঙ্গে যখন থাকতে এসেছিলেন, তিনি রানির দেহরক্ষী ছিলেন। যদিও আমার বাবা মুরব্বি বা খান ছিলেন না, জনসমক্ষে নির্ভীকভাবে কথা বলতে পারায় তাঁকে মুখপাত্র নির্বাচন করা হয়। যদিও তিনি পশতু ভাষায় কাব্যিক ছিলেন, তিনি আমাদের রাষ্ট্রভাষা উর্দু বলতে পারতেন এবং ইংরেজিতেও ঝরঝরে ছিলেন, যার অর্থ তিনি সোয়াতে এবং বাইরেও বেশ ভালো যোগাযোগ স্থাপনকারী।
প্রতিদিন সোয়াত কাউন্সিল অব এল্ডার্স-এর পক্ষে তিনি সেমিনার বা মিডিয়ায় ফজলুল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করতেন। ‘তুমি এটা কী করছ?’ তিনি জিজ্ঞেস করতেন। ‘তুমি আমাদের জীবন এবং সংস্কৃতির ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছ।’
যখন তিনি তাঁর সহ-আন্দোলনকারী বিশেষত পুরোনো বন্ধু আহমেদ শাহ্, মোহাম্মাদ ফারুক ও জাহিদ খানের সঙ্গে দেখা করতেন, আমি প্রায়ই তাঁর সঙ্গে যেতাম। আহমেদ শাহ এরও একটা স্কুল ছিল, যেখানে মোহাম্মাদ ফারুক কাজ করতেন এবং তাঁরা প্রায়ই তাঁর উঠানে জড়ো হতেন। জাহিদ খান ছিল হোটেল মালিক এবং তাঁর একটি বড় বজরা ছিল। তাঁরা আমাদের বাসায় এলে আমি তাঁদের জন্য চা এনে তাঁদের কথা শুনতে চুপচাপ বসে থাকতাম। ‘মালালা শুধু জিয়াউদ্দিনেরই মেয়ে না’, তাঁরা বলতেন, ‘সে আমাদের সবার মেয়ে।’
তারা পেশোয়ার ও ইসলামাবাদে আসা-যাওয়া করতে লাগল এবং রেডিওতে বিশেষত বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকায় পালাক্রমে সাক্ষাৎকার দিতেন, যাতে কেউ না কেউ সব সময় ফ্রি থাকে। তারা মানুষকে জানাত, সোয়াতে যা ঘটছে যা ইসলাম নয়। বাবা বলতেন, আমলা এবং সেনাবাহিনীর কারো কারো সমর্থন ছাড়া সোয়াতে তালেবানের এ উপস্থিতি সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করা, কিন্তু রাষ্ট্র এবং অ-রাষ্ট্রের মাঝে যখন পার্থক্য নির্ণয় করা যায় না তখন অবস্থাটা খুব জটিল হয়ে যায়, রাষ্ট্র যখন অ-রাষ্ট্র থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারবে বলে বিশ্বাস করতে পারি না, তখনো একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
আমাদের মিলিটারি এবং আইএসআই খুবই ক্ষমতাশালী এবং বেশির ভাগ লোক এসব কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পছন্দ করত না, কিন্তু বাবা ও তাঁর অনেক বন্ধু ভয় পেত না। ‘তোমরা যা করছ তা পাকিস্তান এবং তার জনগণের বিরুদ্ধে’, তিনি বলতেন, ‘তালেবানতন্ত্র সমর্থন করবেন না, এটা অমানবিক। আমাদের বলা হচ্ছে যে সোয়াত পাকিস্তানের স্বার্থে উৎসর্গিত হচ্ছে, কিন্তু কাউকে এবং কোনো কিছুকেই রাষ্ট্রের স্বার্থে উৎসর্গ করা উচিত না। রাষ্ট্র হলো মায়ের মতো, আর মা কখনো সন্তানদের ফেলে যায় না বা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে না।’
সবাই যে প্রতিবাদ করতে চায় না, এই মনোভাবটা বাবা ঘৃণা করতেন। নাৎসি আক্রান্ত জার্মানিতে বসবাসকারী কবি মার্টিন নিয়েমায়েলারের লেখা একটি কবিতা তিনি সব সময় পকেটে রাখতেন।
প্রথমে তারা কমিউনিস্টদের জন্য এলো,
আমি কমিউনিস্ট নই, তাই প্রতিবাদ করিনি।
এরপর তারা সমাজবাদীদের জন্য এলো,
আমি সমাজবাদী নই, তাই প্রতিবাদ করিনি।
এরপর তারা শ্রমিকনেতাদের জন্য এলো,
আমি শ্রমিকনেকা নই, তাই প্রতিবাদ করিনি।
তারপর তারা ইহুদিদের জন্য এলো,
আমি ইহুদি নই, তাই প্রতিবাদ করিনি।
তারপর তারা ক্যাথলিকদের জন্য এলো,
আমি ক্যাথলিক নই, তাই প্রতিবাদ করিনি।
এরপর তারা আমার জন্য এলো,
এবং আমার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য তখন কেউ ছিল না।
আমি জানতাম তিনি ঠিকই বলেছেন। মানুষ নীরব থাকলে কিছুই বদলাবে না।
প্রথমে বাবা একটি শান্তিপূর্ণ পদযাত্রার আয়োজন করলেন এবং যা ঘটছে তার ব্যাপারে কথা বলতে আমাদের উৎসাহ দিলেন। মনিবা ভাই বলল, ‘আমরা পশতুনরা ধর্মপ্রেমী লোক’, সে বলল, ‘তালেবানের জন্য সারা বিশ্বের মানুষ আমাদের সন্ত্রাসী বলে, ধরে নিচ্ছে। এটা আসল কথা না। আমরা শান্তিপ্রিয়। আমাদের পর্বত, গাছ, ফুল-সবই শান্তির জন্য পশতুর একমাত্র প্রাইভেট টিভি চ্যানেল এটিভি খাইবার এ আমাদের মেয়েদের একটি দল সাক্ষাৎকার দিলাম। জঙ্গিবাদের কারণে মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার বিষয়ে কথা বললাম। প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিতে হবে, তা নিয়ে শিক্ষকরা আমাদের আগে থেকেই সাহায্য করেছিলেন। শুধু আমিই সাক্ষাৎকার দিইনি। আমরা এগারো-বারো বছর বয়সে একসঙ্গেই তা করতাম, কিন্তু তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সে আমার বন্ধুদের বাবা এবং ভাইরা তাদের অনুমতি দিত না কারণ তারা বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করেছে, তাদের পর্দা করা উচিত এবং তারা ভয়ও পেত।
একদিন আমি আমাদের দেশের অন্যতম খবরের চ্যানেল জিও-তে গেলাম। সেখানে অফিসে একটি স্ক্রিনের দেয়াল ছিল। আমি এত চ্যানেল দেখে অবাক হয়ে গেলাম। পরে আমি ভেবে দেখলাম, ‘মিডিয়ার প্রয়োজন সাক্ষাৎকার। তারা ছোট একটি মেয়ের সাক্ষাৎকার চায়, কিন্তু মেয়েরা ভয় পায়, এবং তারা না পেলেও তাদের বাবা-মা অনুমতি দেয় না। আমার একজন নির্ভীক বাবা আছে, যিনি আমার পক্ষে থাকেন। তিনি বলেন, ‘তুমি একজন শিশু এবং কথা বলা তোমার অধিকার।’ যতই সাক্ষাৎকার দিলাম, আমি ততই শক্তি অনুভব করলাম এবং ততই সমর্থন লাভ করলাম। আমার বয়স ছিল মাত্র এগারো কিন্তু আমাকে আরো বয়স্ক দেখাত এবং মিডিয়া সম্ভবত ছোট মেয়ের কাছ থেকে কথা শুনতেই পছন্দ করত। এক সাংবাদিক আমার নাম দিল ‘তাকরা জেনাই’ উজ্জ্বল তরুণী এবং আরেকজন বলল আমি ‘পাখা জেনাই’ বয়সের তুলনায় জ্ঞানী। আমার হৃদয়ে বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন। আমি যদি আমার অধিকারের জন্য কথা বলি, মেয়েদের অধিকারের জন্য কথা বলি, আমি ভুল কিছুই করছি না। এটা আমার দায়িত্ব। স্রষ্টা দেখতে চান, এমন পরিস্থিতিতে আমরা কী করি। কোরআনে বলা হচ্ছে, ‘মিথ্যাকে চলে যেতে হবে এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।’ যদি একজন লোক, ফজলুল্লাহ, সবকিছু ধ্বংস করতে পারে, একজন মেয়ে কেন সেটা বদলাতে পারবে না? আমি ভাবলাম। প্রতি রাতে আমাকে শক্তি দেওয়ার জন্য আমি স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতাম।
সোয়াতের গণমাধ্যমকে তালেবানের ব্যাপারে ইতিবাচক কাভারেজ দিতে চাপ দেওয়া হচ্ছিল, কেউ কেউ এমনকি তালেবানের মুখপাত্র মুসলিম খানকে শ্রদ্ধাসহকারে ‘স্কুল দাদা’ বলে ডাকত, যদিও বাস্তবে সে স্কুল ধ্বংস করছিল। কিন্তু যা হচ্ছে তা নিয়ে অনেক স্থানীয় সাংবাদিক অখুশি ছিল এবং তারা যা বলার সাহস করছে না তা আমরা বলায় তারা আমাদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি দিল।
আমাদের গাড়ি না থাকায় রিকশায় যাতায়াত করতাম, অথবা বাবার কোনো একজন বন্ধু আমাদের সাক্ষাৎকার দিতে নিয়ে যেতেন। একদিন আমি ও বাবা ওয়াসাতউল্লাহ খান নামের একজন বিখ্যাত কলামিস্ট আমন্ত্রিত এক বিবিসি উর্দু টক শোতে যোগ দিতে পেশোয়ার গেলাম। আমরা বাবার বন্ধু ফজল মওলা এবং তার মেয়ের সঙ্গে গেলাম। দুই বাবা এবং দুই কন্যা। তালেবানের প্রতিনিধি হিসেবে ছিল মুসলিম খান, সে স্টুডিওতে ছিল না। আমি কিছুটা ভীত ছিলাম, কিন্তু জানতাম এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সারা পাকিস্তানের অনেক লোক এটা শুনবে। তালেবানের কত সাহস আমার শিক্ষার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়? ‘আমি বললাম। কোনো উত্তর ছিল না, কারণ মুসলিম খানের ফোন সাক্ষাৎকারটি পূর্ব রেকর্ডকৃত ছিল। রেকর্ডিং কীভাবে সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দেবে?
পরে মানুষজন আমাকে অভিনন্দন জানাল। বাবা হেসে বললেন, আমার রাজনীতিতে যাওয়া উচিত। তিনি আমাকে ক্ষেপাতেন, ‘এক পা-দুই পা হাঁটতে শিখেছিলের সময়ও তুমি রাজনীতিবিদের মতো কথা বলতে।’ কিন্তু আমি নিজে কখনোই নিজের সাক্ষাৎকার শুনতাম না। আমি জানতাম, এগুলো খুবই ছোট ছোট ধাপ।
আমাদের কথাগুলো ছিল বসন্তের বাতাসে উড়ে যাওয়া ইউক্যালিপ্টাস ফুলের মতো। স্কুল ধ্বংস করা থামল না। ২০০৮ সালের ৪ অক্টোবর রাতে আমরা দূরে অনেক বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম। পরদিন কালে আমরা জানলাম, মুখোশ পরিহিত কিছু জঙ্গি মেয়ের জন্য সাঙ্গোতা কনভেন্ট স্কুলে এবং ছেলেদের এক্সেলসিয়র কলেজে ঢুকে উন্নত বিস্ফোরক যন্ত্র (আইইডি) ব্যবহার করে উড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষকদের আগেই স্থানান্তর করা হয়েছিল, কারণ তাঁরা আগে থেকেই হুমকি পাচ্ছিলেন। এগুলো নামকরা স্কুল ছিল, বিশেষত সাঙ্গোতা, যেটা শেষ ওয়ালির আমলে প্রতিষ্ঠিত এবং উন্নতমানের পড়ালেখার জন্য সুনাম ছিল। সেগুলো অনেক বড়ও ছিল, এক্সেলসিয়রের ২০০০-এর ওপরে শিক্ষার্থী ছিল এবং সাঙ্গোতার ছিল ১০০০। বাবা বিস্ফোরণের পর সেখানে গেলেন এবং দেখলেন, ভবনগুলো সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তিনি ভাঙা ইট ও পোড়া বইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে টিভি রিপোর্টারদের কাছে সাক্ষাৎকার দিলেন এবং ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ফিরে এলেন। ‘শুধুই ইট-পাথরের টুকরা পড়ে আছে’ তিনি বললেন।
তবু বাবা আশাবাদী হলেন এবং বিশ্বাস রাখলেন, এই ধ্বংসযজ্ঞের অবসান হওয়ার দিন আসবে। তাঁকে সবচেয়ে বিষণ্ণ করল ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতে লুণ্ঠন হওয়ার ঘটনা-আসবাবপত্র, বই, কম্পিউটার সবকিছু স্থানীয় লোকজন চুরি করে নিয়ে গেছে। এটা শুনে বাবা কেঁদেছিলেন, বলেছিলেন, ‘তারা সবাই মরদেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া শকুন।’
পরদিন তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় একটি সরাসরি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে রাগান্বিতভাবে আক্রমণগুলোর সমালোচনা করলেন। তালেবানের মুখপাত্র মুসলিম খান ফোনে বলেছিলেন। ‘এই স্কুলের কী সমস্যা ছিল যে তোমরা এদেরকে বোমা মেরেছ?’ বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
মুসলিম খান জবাব দিলেন যে সাঙ্গোতা ছিল কনভেন্ট স্কুল এবং তারা খ্রিস্টধর্ম পড়াত। আর এক্সেলাসয়র ছিল কো-এজুকেশনাল, ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়াত। ‘দুটোই মিথ্যা’। বাবার উত্তর। ‘সাঙ্গোতা স্কুল ১৯৬০-এর দশক থেকে সেখানে আছে এবং কাউকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেনি। বরং কেউ কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। আর এক্সেলসিয়র শুধু প্রাথমিক পর্যায়েই ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ায়।
মুসলিম খান কোনো উত্তর দেয়নি। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাদের নিজেদের মেয়েদের কী অবস্থা? তারা কি তাদের শিখতে দিতে চায় না?’
আমাদের প্রধান শিক্ষিকা ম্যাডাম মারিয়াম সাঙ্গোতায় পড়েছেন এবং তাঁর ছোট বোন আয়েশা সেখানকার বর্তমান ছাত্রী, তাই তিনি আর অন্য কিছু ছাত্রী আমাদের স্কুলে ট্রান্সফারকৃত হলো। স্কুলের মাসিক বেতন কখনোই সম্পূর্ণ খরচ মেটাতে সক্ষম ছিল না এবং অতিরিক্ত ফি আমাদের জন্য ভালোই হলো, কিন্তু বাবা অখুশি ছিলেন। তিনি সবখানে গিয়ে দুটো স্কুলেরই পুনর্নির্মাণের দাবি জানালেন। একবার তিনি একটি বড় সমাবেশে একজন দর্শনার্থীর কন্যাশিশুকে উঁচু করে তুলে ধরে বললেন, ‘এই মেয়েটি আমাদের ভবিষ্যৎ। তাকে কি আমরা মূর্খ থাকতে দেব?’ লোকজন নিজের মেয়ের পড়ালেখা থামিয়ে দেওয়ার পূর্বে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়ার জন্য রাজি হলো। নতুন মেয়েগুলোর ভয়াবহ সব কাহিনী ছিল। আয়েশা একদিন আমাদের শোনাল, কীভাবে সে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক তালেবানকে এক পুলিশের ভয়াবহ আঘাতপ্রাপ্ত মাথাকে চুল ধরে ঝোলাতে দেখেছিল, যার ঘাড় থেকে রক্ত পড়ছিল। সাঙ্গোতার মেয়েগুলো খুবই মেধাবী ছিল, যার অর্থ বেশি প্রতিযোগিতা। ওদের মাঝে রিদা নামের এক মেয়ে দারুণ বক্তৃতা দিত। সে আমার এবং মনিবার ভালো বন্ধু হয়ে উঠল, যার জন্য প্রায়ই ঝগড়া হতো কারণ ‘তিন’ একটি চালাকি পূর্ণ সংখ্যা। মনিবা প্রায়ই স্কুলে খাবার আনত এবং কেবল একটা অতিরিক্ত কাঁটাচামচ আনত। ‘তুমি আমার বন্ধু নাকি রিদার?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম।
ও হেসে বলত, ‘আমরা তিনজনই ভালো বন্ধু’। ২০০৮-এর শেষের দিকে তালেবান প্রায় ৪০০ স্কুল ধ্বংস করল। বেনজীরের বিপত্মীক স্বামী প্রেসিডেন্ট আসিফ জারদারির অধীনে আমরা নতুন সরকার পেলাম, কিন্তু তারা সোয়াতের ব্যাপারটা পাত্তাই দিল না। আমি মানুষকে বললাম, জারদারির নিজের মেয়েরা সোয়াতের স্কুলে পড়লে ব্যাপার অন্য রকম হতো। সারা দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা হতে লাগল, এমনকি ইসলামাবাদের ম্যারিয়ট হোটেলও উড়িয়ে দেওয়া হলো।
সোয়াতে দুর্গম জায়গালুলোর চাইতে শহরে থাকাই নিরাপদ ছিল এবং মফস্বল থেকে আমাদের অনেক আত্মীয় আমাদের সঙ্গে থাকতে এলেন। আমাদের অনেক জ্ঞাতি ভাইবোন আগে থেকেই আমাদের সঙ্গে থাকত এবং বাসাটা খুবই কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠল। খুব কম কাজই করার ছিল। আমাদের পছন্দ অনুযায়ী আগের মতো ছাদে বা রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে পারতাম না, তাই উঠানে বারবার মার্বেল খেলতাম। বিরতিহীনভাবে আমি আমার ভাই খুশালের সঙ্গে ঝগড়া করতাম, আর সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে ছুটত। ইতিহাসে মালালা আর খুশালের কখনোই বন্ধুত্ব হয়নি।
আমি চুলে বিভিন্ন স্টাইল করতে পছন্দ করতাম এবং সিনেমায় দেখা বিভিন্ন স্টাইল করার চেষ্টা করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথরুমের আয়নার সামনে কাটাতাম। আমার আট-নয় বছর বয়স পর্যন্ত যা আমার চুল উকুনের কারণে আমার ভাইদের মতো ছোট করে রাখতেন, যাতে ধুতে আর আঁচড়াতে সহজ হয়, যেহেতু আমার চাদরের নিচে চুল এলোমেলো হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত আমি কাঁধ পর্যন্ত চুল রাখতে মাকে রাজি করাতে পারলাম। মনিবার চুল সোজা ছিল কিন্তু আমারটা ঢেউখেলানো, এবং আমি তাদেরকে কোঁকড়াতে বা বেণি বাঁধতে পছন্দ করতাম। ‘পিশো, তুমি ওখানে কী করছ? মা চিৎকার করতেন।’ মেহমানদের শৌচাগার ব্যবহার করা দরকার এবং তোমার জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
২০০৮ সালে রমজান মাসের সংযমের সময়টা ছিল সবচেয়ে খারাপ সময়গুলোর মাঝে একটা। রমজানে দিনের আলো থাকতে কোনো খাবার বা পানীয় একজন মুসলিমের মুখ অতিক্রম করতে পারে না। তালেবান পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ায় আমাদের বিদ্যুৎ ছিল না, কদিন পর তারা পাইপলাইন ফাটিয়ে দেওয়ায় গ্যাসও চলে গেল। বাজারের গ্যাস সিলিন্ডারের দাম দ্বিগুণ হয়ে পড়ায় মা গ্রামের মতো আগুন জ্বালিয়ে রান্না করলেন। তিনি অভিযোগ করেননি, খাবার রান্না করার দরকার এবং মা তা করেছেন, এবং আমাদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় অনেকেই ছিল। কিন্তু পরিষ্কার পানি ছিল না এবং কলেরায় মানুষ মারা যাওয়া শুরু করল। হাসপাতালে সব রোগীর জায়গা হলো না এবং চিকিৎসা করাতে বাইরে বড় তাঁবু টানাতে হলো।
বাসায় জেনারেটর না থাকলেও বাবা স্কুলের জন্য একটা কিনলেন এবং মাটি খুঁড়ে তৈরি করা গর্ত থেকে পানি পাম্প করে তোলা হলো, যা আশপাশের সব বাড়ির বাচ্চারা সংগ্রহ করতে গেল। প্রতিদিন জগ, বোতল, ড্রাম ভরতে অপেক্ষমাণ লোকের সারি দেখা যেত। এক প্রতিবেশী ভয় পেয়ে গেলেন। ‘আপনি কী করছেন?’ সে জিজ্ঞেস করল। ‘তালেবান যদি জানতে পারে আপনি রমজান মাসে আমাদের পানি দিচ্ছেন, তারা এখানে বোমা মারবে।’
বাবা উত্তরে বললেন, মানুষ পিপাসা অথবা বোমা যেকোনোটাতেই মারা যেতে পারে।
আমাদের পিকনিকে যাওয়ার দিনগুলো স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল। সূর্যাস্তের পর কেউ ঘর থেকে বেরোত না। সন্ত্রাসীরা স্কি লিফট এবং মালাম জাব্বায় পর্যটকদের থাকার একটি বড় হোটেলও উড়িয়ে দিল। একটি অবকাশযাপনের স্বর্গ পরিণত হলো নরকে, যেখানে কোনো পর্যটকই আসে না। এর পর ২০০৮-এর শেষদিকে, ফজলুল্লাহর ডেপুটি মওলানা শাহ দাউরান ঘোষণা দিল যে, সব মেয়ের স্কুল বন্ধ করে দিতে হবে। ১৫ জানুয়ারি থেকে মেয়েরা স্কুলে যাবে না বলে সে হুঁশিয়ার করে দিল। প্রথমে আমি এটাকে একটা রসিকতা হিসেবেই নিলাম। ‘তারা কীভাবে আমাদের স্কুলে যাওয়া থামাবে?’ আমি আমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম। ‘তাদের এই ক্ষমতা নেই। তারা বলছে, তারা পর্বত ধ্বংস করে দেবে; কিন্তু রাস্তাটা পর্যন্ত তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’
অন্য মেয়েরা আমার সঙ্গে একমত হলো না। ‘কে তাদের থামাবে?’ তারা জিজ্ঞেস করল। ‘তারা ইতোমধ্যে শত শত স্কুল উড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু কেউ কিছু করেনি।’
বাবা বলতেন যে সোয়াতের মানুষজন এবং শিক্ষকরা তত দিন বাচ্চাদের শিক্ষাদান করে যাবে, যত দিন পর্যন্ত শেষ কক্ষ, শেষ শিক্ষক এবং শেষ শিক্ষার্থীটি জীবিত থাকবে। আমার বাবা-মা একবারও আমাকে স্কুল বাদ দেওয়ার কথা বলেনি, কখনোই না। যদিও আমরা স্কুল ভালোবাসতাম, তালেবান আমাদের থামানোর চেষ্টা করার আগ পর্যন্ত আমরা বুঝিনি শিক্ষা কত মূল্যবান। স্কুলে যাওয়া, পড়া এবং বাড়ির কাজ করা কেবল সময় কাটানোর বিষয়ই নয়, এটা আমাদের ভবিষ্যৎ।
সেবার শীতে তুষারপাত হলো এবং আমরা তুষার ভালুক তৈরি করলাম, তবে তাতে বেশি আনন্দ ছিল না। শীতে তালেবান পাহাড়ে চলে যেত কিন্তু আমরা জানতাম তারা ফিরে আসবে এবং এরর কী হবে সে বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। আমরা বিশ্বাস করতাম যে স্কুল আবারও শুরু হবে। তালেবান আমাদের কলম এবং বই নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমাদের মনকে তো তারা চিন্তা করা থেকে থামাতে পারবে না।
(চলবে)