আমি মালালা বলছি
আজব শান্তি
শীতের ছুটির পর আমার ভাইদের স্কুল যখন খুলল, খুশাল বলল সে আমার সাথে বাসায় থাকবে। আমি রেগে গেলাম। ‘তুমি জানো না তুমি কত ভাগ্যবান,’ আমি তাকে বললাম। স্কুল না থাকায় আমার খুব অদ্ভুত লাগল। আমরা ইসলামাবাদ থাকতে কেউ একজন আমাদের টিভিটা চুরি করে ফেলায় আমাদের টিভিও ছিল না, বাবার ‘পালিয়ে যাওয়ার মইটা ব্যবহার করেই কাজটা হয়।
কেউ এখন আমাকে পাওলো কোয়েলহো-এর ‘দি অ্যালকেমিস্ট’-এর একটি কপি দিল, সেখানে এক মেষপালকের কথা আছে যে অবসর সময়ে ধনরত্নের খোঁজে পিরামিডে ঘুরে বেড়ায়। সেটায় বলা আছে, ‘তুমি যখন কিছু চাও তখন পুরো মহাবিশ্ব তোমাকে সেটা অর্জন করানোর জন্য পরিকল্পনা করে’। আমার মনে হয় না যে পাওলো কোয়েলহো তালেবানদের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন বা আমাদের অর্বাচীন রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে এসেছেন।
আমি জানতাম না যে হাই কাকা ফজলুল্লাহ ও তাঁর কমান্ডারদের সাথে গোপন বৈঠক করছিলেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের সম্পর্কে জানলেন তিনি এবং মেয়েদের স্কুলের ব্যাপারে তাদের নিষেধাজ্ঞাটা পুনর্বিবেচনা করতে বললেন।
‘শোনো, মাওলানা,’ তিনি ফজলুল্লাহকে বললেন, ‘তুমি মানুষ খুন করেছ জবাই করেছ, শিরশ্ছেদ করেছ, স্কুল ধ্বংস করেছ কিন্তু গোটা পাকিস্তানে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। কিন্তু তুমি মেয়েদের শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেই মানুষ জেগে উঠল। এমনকি যে পাকিস্তান মিডিয়া তোমাদের প্রতি এত নমনীয় ছিল, তারাও এখন ফুঁসে উঠছে।’
সারাদেশ থেকে আগত চাপটা কাজ করল এবং ফজলুল্লাহ ১০ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের পড়ালেখা করার অনুমতি দিলেন অর্থাৎ চতুর্থ শ্রেণি। আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম এবং কেউ কেউ ভান করলাম- আমাদের বয়স কম। আমরা চাদরের নিচে বই লুকিয়ে সাধারণ কাপড় পরে আবারও স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। এটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কিন্তু আমার একমাত্র এই লক্ষ্যটাই পূরণ হচ্ছিল। আমরা ভাগ্যবতীও ছিলাম, কারণ ম্যাডাম মারিয়াম সাহসী ছিলেন এবং কাজ করা বন্ধ করতে যে চাপ আসছিল তা তিনি প্রতিরোধ করলেন। দশ বছর বয়স থেকেই তিনি আমার বাবাকে চেনেন এবং একে অপরকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে আসছেন। বাবা অনেক বেশি কথা বলতে থাকলে তিনি তাঁকে থামার ইশারা করতেন, যেটা প্রায়ই হতো।
এই গোপন স্কুল আমাদের নীরব প্রতিবাদ, তিনি আমাদের বললেন।
এটার ব্যাপারে আমি আমার ডায়েরিতে কিছুই লিখলাম না। তারা আমাদের ধরতে পারলে চাবুক মারবে বা শাবানার মতো জবাইও করে ফেলতে পারে। কোনো কোনো মানুষ ভূতে ভয় পায়, কেউ কেউ মাকড়সা বা সাপ ভয় পায় সেসব দিনে আমরা ভয় পেতাম আমাদেরই স্বজাতি মানুষকে।
স্কুলের পথে আমি প্রায়ই টুপি এবং লম্বা নোংরা চুলওয়ালা তালেবানদের দেখতে পেতাম। বেশির ভাগ সময় তারা মুখ ঢেকে থাকত। তারা দেখতে ছিল বেঢপ এবং ভয়ানক। এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী মিঙ্গোরা ছেড়ে চলে যাওয়ায় রাস্তাগুলো খুবই ফাঁকা ফাঁকা ছিল। বাবা বলেছিলেন, উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ায় মানুষকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না কারণ সরকারের কোনো ক্ষমতা নেই। তখন এলাকায় প্রায় ১২ হাজার সেনা ছিল-তালেবানদের সংখ্যা সম্পর্কে তাদের ধারণার চারগুণ-ট্যাংক, হেলিকপ্টার এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ। তবু সোয়াতের শতকরা সত্তর ভাগ ছিল তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ আমরা স্কুলে যাওয়া শুরু করার এক সপ্তাহ পর, এক রাতে গুলির শব্দে আমরা জেগে উঠলাম। আমাদের লোকজন সাধারণত সন্তানের জন্ম এবং বিয়ে উদযাপন করতে রাইফেল দিয়ে গুলি ছোড়ে, কিন্তু এই সময় সেগুলোও বন্ধ। তাই প্রথমে আমরা মনে করলাম যে বিপদ এসেছে। তখনই আমরা খবরটা জানতে পারলাম। গুলিগুলো ছিল উদযাপন। তালেবান এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে একটা শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। প্রাদেশিক সরকার এখন মোল্লা নয়, এএনপির নিয়ন্ত্রণে। সরকার সোয়াতে শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে এবং বিনিময়ে জঙ্গিদের যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। তালেবানরা দশ দিনের সাময়িক শান্তিচুক্তিতে রাজি হলো এবং এর প্রতীক হিসেবে ছয় মাস আগে অপহৃত এক চীনা টেলিফোন প্রকৌশলীকে মুক্তি দিল।
আমরাও খুশি হয়েছিলাম। আমার বাবা প্রায়ই শান্তিচুক্তির পক্ষে কথা বলতেন কিন্তু আমরা এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মানুষ আশা করল যে তালেবানরা শান্ত হয়ে যাবে, বাড়ি ফিরে গিয়ে শান্তিপূর্ণ সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করবে। তারা নিজেদের বুঝ দিল যে সোয়াতের শরিয়াহ আইন আফগানদের চেয়ে আলাদা হবে, আমাদের বালিকা বিদ্যালয়গুলো তখনো থাকবে এবং মোরালিটি পুলিশ থাকবে না। সোয়াত, কেবল ভিন্ন একটা বিচারব্যবস্থা নিয়ে সোয়াতই থাকবে। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাইলেও চিন্তিতই থাকলাম। আমি ভাবলাম, নিশ্চিতভাবেই কর্মপ্রক্রিয়াটা নির্ভর করছে যারা এর তত্ত্বাবধান করছে তাদের ওপর। তারা তালেবান।
আর এটাও বিশ্বাস করা শক্ত যে সবই চুকেবুকে গেছে। হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ এবং পুলিশ খুন হয়েছে। মহিলাদের পর্দায় রাখা হয়েছে, স্কুল এবং সেতু উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। নৃশংস গণ-আদালত এবং সহিংস বিচার ভোগ করেছি আমরা একটা স্থির ভয়ের মাঝে বসবাস করেছি। আর এখন সবই থেকে যাচ্ছে।
সকালে খাওয়ার সময় ভাইদের কাছে আমি প্রস্তাব দিলাম যে এখন আমাদের যুদ্ধের কথা না বলে শান্তির কথা বলা উচিত। আজীবন যা হয়ে এসেছে, তার পুনরাবৃত্তি করেই তারা আমাকে পাত্তা না দিয়ে তাদের যুদ্ধের খেলা চালিয়ে যেতে লাগল। খুশালের ছিল একটা খেলনা হেলিকপ্টার, অতলের ছিল একটা কাগজের পিস্তল, একজন চিৎকার করত, ‘ফায়ার’। এবং অন্যজন বলত, ‘পজিশন নাও।’ আমি পাত্তা দিলাম না। আমি গিয়ে আমার ইউনিফর্মটা দেখলাম, খুশি হলাম যে শিগগিরই আবার এটা খোলাখুলিভাবে পরতে পারব। প্রধান শিক্ষিকার বার্তা এলো যে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা, আবার বই হাতে নেওয়ার সময় হয়েছে।
আমাদের উত্তেজনা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ঠিক দুদিন পর আমি তাজমহল হোটেলের ছাদে খ্যাতনামা রিপোর্টার হামিদ মীরকে শান্তিচুক্তি সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলাম। এ সময় খবর এলো, আমাদের চেনাজানা আরেক টিভি রিপোর্টারকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁর নাম মুসা খান খেল। তিনি প্রায়ই বাবার সাক্ষাৎকার নিতেন। সেদিন তিনি সুফি মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন একটি শান্তিপূর্ণ পদযাত্রার খবর সংগ্রহ করছিলেন। ওটা আসলে পদযাত্রা ছিল না, ছিল গাড়ির শোভাযাত্রা। পরে মুসা খানের শরীর কাছেই পাওয়া যায়। তাঁকে কয়েকবার গুলি করা হয়েছিল এবং গলা আংশিক কাটা ছিল। তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর।
মাকে এটা বলার পর তিনি এতই দুঃখ পেলেন যে চোখে পানি নিয়ে শুতে গেলেন। তিনি চিন্তিত ছিলেন যে শান্তিচুক্তির এত কম সময়ের মাঝেই এই উপত্যকায় নৃশংসতা ফিরে এসেছে। চুক্তিটা কি আসলে একটা বিভ্রম ছিল? তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন।
কদিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি মিঙ্গোরার সোয়াতে প্রেসক্লাবে ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ জাভিদ ‘স্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করে সব সোয়াতিকে সোয়াতে ফিরে আসতে আহ্বান জানান। তালেবান মুখপাত্র মুসলিম খান তখন নিশ্চিত করল যে তারা অনির্দিষ্টকাল যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জারদারি একে আইনের আওতায় এসে স্বাক্ষর করবেন। সরকার ভুক্তভোগীদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হলো।
সোয়াতের সবাই বিজয়ানন্দে উৎফুল্ল হলেও আমিই সবচেয়ে খুশি ছিলাম, কারণ এর অর্থ হলো আবারও ঠিকমতো স্কুল খুলবে। তালেবানরা বলল যে শান্তিচুক্তির পর স্কুলে যেতে পারবে কিন্তু তাদের আবৃত থাকতে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে তোমরা যদি সত্যিই তাই চাও, যতদিন দেহে প্রাণ আছে ততদিন তাই করে যাব।
সবাই এই সমঝোতায় খুশি ছিল না। আমাদের মার্কিন মিত্ররা ভয়ানক রেগে গেল। ‘আমার মনে হলো, পাকিস্তান সরকার তালেবান এবং চরমপন্থীদের ছেড়ে দিচ্ছে। ‘মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন বললেন। মার্কিনরা চিন্তিত হয়ে পড়ল এই ভেবে যে, এই শান্তিচুক্তির আড়ালে আছে আত্মসমর্পণ। পাকিস্তানি খবরের কাগজ ‘ডন’ সম্পাদকীয় লিখল যে চুক্তিটা একটা ‘বিপদসংকেত পাঠাচ্ছে-রাষ্ট্রের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধ করো, তুমি যা চাও সে তোমাকে তাই দেবে আর বিনিময়ে নিজে কিছুই পাবে না।’
কিন্তু এসব লোকজনের কারোই তো এখানে থাকতে হয়নি। আমাদের শান্তি দরকার ছিল, সেটা যে-ই আনুক না কেন। আমাদের ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি হলো সাদা দাড়িওয়ালা জঙ্গি সুফি মোহাম্মদ। সে দির-এ একটা ‘শান্তিক্যাম্প’ করে জমিদারের মতো আমাদের বিখ্যাত মসজিদ তাবলিগ মারকাজে বসল। সে-ই গ্যারান্টি দিল যে তালেবানরা অস্ত্র রাখবে এবং উপত্যকায় শান্তি আসবে। মানুষ তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এবং তার হাত চুম্বন করতে সেখানে যেত, কারণ সবাই যুদ্ধ এবং আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছিল।
হাই কাকা ভাবলেন যে আর বেশি কিছু বলার নেই, তাই মার্চ মাসে আমি ব্লগে লেখা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু তীব্র আতঙ্কের সঙ্গে দেখলাম যে বিশেষ কিছুই বদলায়নি। কিছু বদলে থাকলে তা হলো, তালেবানরা আরো নৃশংস হয়ে উঠল। তারা এখন রাষ্ট্র অনুমোদিত সন্ত্রাসী। আমরা বিভ্রান্ত এবং হতাশ হয়ে পড়লাম। শান্তিচুক্তিটা ছিল প্রকৃতপক্ষে মরীচিকা। এক রাতে তালেবানরা আমাদের রাস্তার কাছে পতাকা শোভাযাত্রা করল এবং সেনাবাহিনীর মতো বন্দুক আর লাঠি নিয়ে রাস্তা টহল দিল।
তারা তখনো চীনাবাজার টহল দিচ্ছিল। একদিন আমার এক জ্ঞাতিবোনের বিয়ে উপলক্ষে মা আর সে নিজে বাজার করতে যাচ্ছিল। পথে এক তালিব তাদের গায়ে পড়ে থামাল। ‘তোমাদের যদি আর কোনোদিন দেখি বোরখা ছাড়া শুধু ওড়না পরে আছ, আমি তোমাদের পেটাব’, সে বলল। মা সহজে ভয় পান না এবং তখনো শান্ত থাকলেন। ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে আমরা ভবিষ্যতে বোরখা পরব’, তিনি বললেন। মা সব সময় মাথা ঢেকে রাখেন কিন্তু বোরখা পশতুন সংস্কৃতির অংশ নয়।
আমরা এটাও শুনলাম যে অভিভাবকহীন এক নারী এক দোকানের লিপস্টিকের দিকে তাকাচ্ছিল বলে তালেবানরা দোকানিকে আক্রমণ করেছে। ‘বাজারে ব্যানার টানানো আছে যে পুরুষ অভিভাবকহীন কোনো নারী দোকানে ঢোকার অনুমতি পাবে না। তবু তুমি আমাদের নির্দেশ অমান্য করেছ’, তারা বলল। তাকে অনেক খারাপভাবে মারা হলো কিন্তু তাকে সাহায্য করার কেউ ছিল না।
একদিন বাবা আর তাঁর বন্ধুরা মিলে ফোনে একটা ভিডিও দেখছিলেন। সেটা অত্যন্ত ভয়াবহ ভিডিও ছিল। এক কিশোরী কালো বোরখা এবং লাল পায়জামা পরে মাটির দিকে মুখ করে শুয়ে আছে এবং কালো পাগড়ি পরা এক দাড়িওয়ালা লোক প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে চাবকাচ্ছে। ‘দয়া করে থামাও!’ সে চিৎকার এবং কাতর স্বরে গোঙানোর মাঝে মাঝে পশতুতে বলছিল, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে, আমি মারা যাচ্ছি।’
তালেবানটি চিৎকার করছিল, ‘ওকে নিচে চেপে ধরে রাখো। ওর হাত নিচে চেপে রাখো’। একপর্যায়ে তার বোরখা উঠে যায় এবং তারা তাকে সেটা মুহূর্ত সময় দিয়ে আবার মারা শুরু করে। তারা তাকে চৌত্রিশবার মারে। আশপাশে ভিড় জমে গিয়েছিল কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। মহিলার এক আত্মীয় বরং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাকে নিচে চেপে ধরে রাখতে সাহায্য করছিল।
কয়েকদিনের মধ্যেই ভিডিওটা ছড়িয়ে পড়ল। ইসলামাবাদের এক নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা এটা লুফে নিলেন এবং এটা বারবার পাকিস্তান টিভিতে দেখানো হলো, এরপর ছড়িয়ে গেল সারা বিশ্বে। মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে উপত্যকার ঘটনাগুলো নিয়ে ফুঁসে উঠল। আমি চাইলাম তাদের ক্ষোভটা যেন নারীশিক্ষার ওপর তালেবানদের নিষেধাজ্ঞার প্রতিও আসে। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি অনুসন্ধানের আহ্বান জানালেন এবং চাবুক মারাকে ইসলামের শিক্ষার বিরোধী বলে বিবরণ দিলেন। ‘ইসলাম নারীর সাথে ভদ্র ব্যবহার করতে শেখায়’ তিনি বললেন।
কেউ কেউ এমনকি ভিডিওটা নকল বলেও দাবি করল। অন্যরা বলল যে এই ঘটনা শান্তিচুক্তির আগে জানুয়ারিতে ঘটেছিল এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে এখন ছাড়া হয়েছে। কিন্তু মুসলিম খান নিশ্চিত করলেন যে এটা আসল। ‘সে তার স্বামী নয় এমন একজনের সাথে বাসা থেকে বের হওয়ায় আমরা তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হই’, সে বলল। কিছু কিছু সীমা অতিক্রম করা যায় না।
প্রায় একই সময়ে এপ্রিলের শুরুর দিকে জাহিদ হুসেইন নামের এক নামকরা সাংবাদিক সোয়াতে এলেন। তিনি ডিসির কার্যালয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখতে পেলেন, তালেবানি পুনর্দখল উপলক্ষে উদযাপন হচ্ছে যার আয়োজক হলেন ডিসি নিজে। বেশ কয়েকজন প্রবীণ তালেবান নেতা ছিলেন, এবং তাদের সাথে ছিল মুসলিম খান এবং ফকির মোহাম্মদের মতো অস্ত্রধারী রক্ষী; ফকির মোহাম্মদ ছিল বাজাউরের জঙ্গিদের নেতা এবং তারাই সেনাবাহিনীর সাথে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মূলে ছিল। ফকিরের মস্তকের জন্য দুই লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল এবং এই হুমকি মাথায় নিয়েও সে এক সরকারি কর্মকর্তার বাসায় নৈশভোজ করছিল। আমরা এটাও শুনলাম যে এক আর্মি ব্রিগেডিয়ার নাকি ফজলুল্লাহর নেতৃত্বে নামাজ পড়ে।
‘একই খাপে দুটো তলোয়ার থাকতে পারে না’, বাবার এক বন্ধু বললেন। ‘একই রাজ্যে দুই রাজা থাকতে পারে না। এখানকার দায়িত্বে কে আছে-সরকার না ফজলুল্লাহ?’
কিন্তু আমরা তবু শান্তিতে বিশ্বাসী ছিলাম। সবাই ২০ এপ্রিলের একটি জনসভার জন্য অপেক্ষা করছিল, যেখানে সুফি মোহাম্মদ সোয়াতবাসীর উদ্দেশে কথা বলবে।
সেদিন সকালে আমরা সবাই বাসায় ছিলাম। বাবা আর ভাইরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় একদল তালেবান কিশোর মোবাইলে বিজয় সংগীত বাজাতে বাজাতে তাঁদের পাশ কাটিয়ে গেল। ‘আবা, ওদেরকে দেখো, খুশাল বলল। ‘আমার একটা কালাশনিকভ থাকলে আমি ওদের মেরে ফেলতাম।’
বসন্তের এক চমৎকার দিন ছিল সেটা। সবাই উত্তেজিত ছিল, কারণ আশা ছিল যে সুফি মোহাম্মদ শান্তি ও বিজয় ঘোষণা করবে এবং তালেবানদের অস্ত্র নামিয়ে রাখতে বলবে। বাবা জনসভায় যাননি। বাবা তাঁর বন্ধু আহমদ শাহর স্কুল সারস একাডেমির ছাদ থেকেই জনসভা দেখলেন, যেখানে তিনি এবং তাঁর সহ-আন্দোলনকারীরা প্রায়ই জড় হতেন। ছাদের ওপর থেকে মঞ্চটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, তাই কোনো কোনো মিডিয়া সেখানে ক্যামেরা সেট করেছিল।
বিরাট বড় ভিড় হয়েছিল-প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক, সবাই পাগড়ি পরা এবং তালেবানি গান আর জিহাদি গান গাইছিল। ‘সেটা ছিল সম্পূর্ণ তালেবানি ঐকতান’, বাবা বলেছিলেন। তাঁর মতো স্বাধীনচেতা প্রগতিশীল ব্যক্তি এসব গান আর স্লোগান উপভোগ করেননি। তাঁদের মতে এগুলো বিষাক্ত বিশেষত এমন সময়ে।
সুফি মোহাম্মদ মঞ্চে বসে ছিলেন এবং তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে আসা লোকের সারি ছিল বিশাল। অনুষ্ঠান শুরু হলো কোরআনের ‘বিজয়ের অধ্যায়’ অর্থাৎ এ সংক্রান্ত একটা সুরা দিয়ে। এরপর হলো কোহিস্তান, মালাকান্দ, শাংলা, উচ্চ এবং নিম্ন দির এই পাঁচ জেলার পাঁচ নেতার ভাষাণ। তারা খুবই আগ্রহী ছিলেন কারণ সবাই জেলার আমির হওয়ার ইচ্ছা এবং আশা পোষণ করছিলেন, যাতে শরীয়তের আইন প্রবর্তনের দায়িত্বে থাকতে পারেন। পরে ওসব নেতারা হয় খুন হবে বা জেলে পাঠানো হবে, তাতে কী? এর আগে ক্ষমতা তো কিছুদিন ভোগ করা যাবে! তাই সবাই দায়িত্ব নিয়ে কথা বলল, নবীজি (স.)-এর মক্কা বিজয়ের পর যেমন আনন্দ উদযাপন হয়েছিল তালেবানরাও বক্তৃতার পর তেমন উদযাপন করলো। অবশ্য নবীজি (স.) বাণী ছিল ক্ষমার, সেখানে হিংসার কথা ছিল না।
এবার সুফি মোহাম্মদের পালা। সে ভালো বক্তা ছিল না। তার বয়স ছিল অনেক, স্বাস্থ্যও খারাপ ছিল এবং পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলল। সে এতসব অপ্রত্যাশিত কথা বলল যে মনে হলো যে অন্য কারো জিভ তার মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে পাকিস্তানের আদালতকে অনৈসলামিক আখ্যা দিয়ে বলল, ‘আমি মনে করি কাফেররা পশ্চিমা গণতন্ত্র আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। ইসলাম গণতন্ত্র বা নির্বাচন অনুমোদন করে না।’
সুফি মোহাম্মদ শিক্ষা নিয়ে কিছুই বলল না। সে তালেবানদের অস্ত্র নামিয়ে রেখে হুজরা ছেড়ে যেতেও বলল না। বরং সে সমগ্র জাতিকে হুমকি দিল। ‘এখন অপেক্ষা করো, আমরা ইসলামাবাদে আসছি,’ সে চিৎকার করে বলল।
আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। জ্বলন্ত আগুনে পানি ঢালার মতো ব্যাপার- শিখাগুলো হঠাৎ নিভে যায়। মানুষ খুবই আশাহত ছিল এবং তাকে গালিগালাজ করা শুরু করল। ‘ওই শয়তানটা কী বলেছে?’ মানুষ জিজ্ঞেস করত। ‘সে শান্তি চায় না, সে আরো খুন চায়’। আমার মা-ই সবচেয়ে ভালো বললেন। ‘তার হাতে ইতিহাসের নায়ক হওয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু সে সুযোগ নেয়নি,’ মা বললেন। ফেরার পথে আমাদের মনোভাব ছিল সভায় যাত্রা করার সময়ের মনোভাবের ঠিক বিপরীত।
সেদিন রাতে বাবা জিয়ো টিভিতে কামরান খানকে বললেন যে মানুষের উচ্চাশা ছিল কিন্তু সবাই হতাশ হয়েছে। সুফি মোহাম্মদ তাঁর করণীয় করেননি। তাঁর উচিত ছিল তাঁর বক্তব্য দ্বারা শান্তিচুক্তিটা নিশ্চিত করে বিরোধ দূর করে সহিংসতার সমাপ্তি ঘটানো।
মানুষ ঘটনাটা নিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আনল। কেউ কেউ বলল, সুফি মোহাম্মদ পাগল হয়ে গেছেন। অন্যরা বলল, তাঁকে হুমকি দিয়ে এই বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে। ‘তুমি যদি তা না করো, সেখানে চার-পাঁচজন আত্মঘাতী বোমারু তোমাকেসহ আশপাশের সবাইকে মেরে ফেলবে।’ মানুষ বলল কথা বলার আগে মঞ্চে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে অস্বস্তিতে আছে। তারা অদৃশ্য হাত এবং অদেখা শক্তির কথা বলতে লাগল। ‘তাতে কী হলো?’ আমি ভাবলাম। ‘ব্যাপারটা হলো যে আমরা একটা তালেবান রাষ্ট্রে থাকছি।’
বাবা আবারও তালেবানদের জন্য হওয়া সমস্যা নিয়ে সেমিনারে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। একটাতে আমাদের প্রদেশের তথ্যমন্ত্রী বললেন যে তালেবানায় হলো আমাদের দেশে জঙ্গিদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে পাঠানোর ফল, প্রথমে রাশিয়ার সাথে, এরপর আমেরিকার সাথে। ‘বিদেশি শক্তির আদেশে যদি আমরা মাদ্রাসা ছাত্রদের হাতে বন্দুক তুলে না দিতাম তবে আমাদের উপজাতীয় এলাকা এবং সোয়াতে এই রক্তস্নানের মুখোমুখি হতে হতো না’, তিনি বললেন।
শিগগিরই পরিষ্কার হয়ে গেল যে মার্কিনরা চুক্তিটার ঠিকই মর্মোদ্বার করেছিল। তালেবানরা ভেবেছিল যে পাকিস্তান সরকার আত্মসমর্পণ করেছে এবং তারা যা খুশি করতে পারবে। তারা সোয়াতের দক্ষিণ-পূর্ব জেলা এবং ইসলামাবাদ থেকে মাত্র পঁয়ষট্টি মাইল দূরে বুনেরে ঢুকল। ওরা আরপিজি এবং বন্দুক নিয়ে ঢুকতেই তাদের ‘অত্যাধুনিক অস্ত্র’ আছে বলে পুলিশ পোস্ট ছেড়ে চলে গেল এবং লোকজন পালাল। তালেবানরা সব জেলায় শরিয়ত আদালত স্থাপন করে যুবাদের যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে মসজিদ থেকে খুতবা দিতে লাগল।
সোয়াতের মতোই তারা টিভি সেট, ছবি, ডিভিডি, টেপ পোড়াল। তারা এমনকি পীরবাবা নামের এক সুফি সাধকের মাজার দখল করল, যেটা তীর্থস্থানও ছিল। মানুষ আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা রোগ নিরাময় এবং সন্তানদের সুখী দাম্পত্যের জন্য সেখানে যেত। এখন সেটা তালা দেওয়া।
পাকিস্তানের নিচের দিকের জেলার লোকেরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল, কারণ তালেবানরা রাজধানীর দিকে যাচ্ছে। সবাই-ই বোরখা পরা মেয়েটার চাবুক খাওয়ার ভিডিওটা দেখেছিল এবং জিজ্ঞেস করছিল, ‘এই পাকিস্তানই কি আমরা চেয়েছিলাম?’ জঙ্গিরা বেনজিরকে হত্যা করেছিল, সবচেয়ে বিখ্যাত হোটেলটা উড়িয়ে দিয়েছে, শিরশ্ছেদ আর আত্মঘাতী হামলায় হাজার হাজার লোককে মেরেছে এবং শত শত স্কুল ধ্বংস করেছে। আর কত কিছু করলে সরকার সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করার পদক্ষেপ নেবে?
ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ওবামার সরকার মাত্র ঘোষণা দিয়েছিল যে আফগানিস্তানে তালেবানের বিরুদ্ধে তারা আরো ২১ হাজার সৈন্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু এখন মনে হলো, তারা আফগানিস্তানের চেয়ে পাকিস্তানকে নিয়ে বেশি শঙ্কিত। শুধু আমার মতো মেয়ে আর আমার স্কুলের মতো স্কুলের জন্য নয়, শঙ্কার কারণ ছিল যে আমাদের দেশে ২০০ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে এবং তার নিয়ন্ত্রণ করবে কে? তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সাহায্য পাঠানোর পরিবর্তে সৈন্য পাঠানোর কথা বলতে লাগল।
মে মাসের শুরুর দিকে আমাদের সেনাবাহিনী সোয়াত থেকে তালেবানদের উচ্ছেদ করতে অপারেশন ট্রু পাথ পরিচালনা করল। আমরা শুনলাম উত্তরে তারা পর্বতের ওপর হেলিকপ্টার থেকে শত শত কমান্ডো নামিয়েছিল। মিঙ্গোরায়ও আরো সৈন্য এলো। এবার তারা পুরো শহর খালি করে দেবে। মেগাফোনে সব অধিবাসীকে বাড়ি ছাড়তে বলা হলো।
আমার বাবা বললেন যে, আমাদের থাকা উচিত। কিন্তু গুলির শব্দে প্রায় রাতেই আমরা জেগে থাকতাম। সবাই এক স্থির উদ্বেগের মাঝে ছিল। এক রাতে আমরা চেগনোর শব্দে জেগে উঠলাম। কদিন আগে থেকে আমরা কিছু প্রাণী পুষছিলাম-তিনটি সাদা মুরগি আর খুশালের বন্ধুদের দেওয়া বাড়ির ভেতর ঘুরে বেড়ানো একটা খরগোশ। অতলের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর এবং সে খরগোশটাকে এত ভালোবাসত যে ওটা আমার বাবা-মায়ের বিছানার নিচে ঘুমাত। কিন্তু সে সবখানে মূত্রত্যাগ করত বলে রাতে তাকে বাইরে রাখা হতো। মাঝরাতের কাছাকাছি সময়ে একটা বিড়াল এসে ওটাকে মেয়ে ফেলেছিল। আমরা খরগোশটার যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ শুনলাম। অতল কান্না থামাতে পারছিল না। ‘সকাল হোক, আমি কাল বিড়ালটাকে উচিত শিক্ষা দেব’, সে বলল। ‘আমি তাকে মেরে ফেলব’। মনে হলো, এটা একটা অশুভ সংকেত।
(চলবে)