মামলা দায়েরের পর কি প্রত্যাহার করা যায়?
ঢাকার মুখ্য মহানগর (সিএমএম) হাকিমের আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ভেবেছিলেন নাহিদা সুলতানা (ছদ্মনাম)। মামলার আগে একটা বিষয় নিয়ে মহাচিন্তায় পড়ে যান তিনি। ভাবেন, মামলার পর স্বামী তাঁর সঙ্গে সংসার করে কি না। আবার মামলা দায়েরের পর সেটি প্রত্যাহার করা যাবে কি না, তা নিয়েও চিন্তায় পড়ে যান তিনি। পরে একজন আইনজীবীর পরামর্শে সংশয় কাটে নাহিদার। তিনি তাঁকে মামলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সব পরামর্শ দেন।
নাহিদা সুলতানার মতো হাজারো বিচারপ্রার্থী আদালতে মামলা করার আগে চিন্তা করেন, প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ আছে কি না। তবে আইন অনুযায়ী, মামলা প্রত্যাহার করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় জানা থাকা জরুরি।
ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার
ফৌজদারি মামলা সাধারণত দুই ধরনের : সিআর ও জিআর।
জিআর মামলা সাধারণত থানায় দায়ের করা হয়। আর সিআর মামলা দায়ের করতে হয় ফৌজদারি আদালতে।
জিআর মামলায় বাদীর পক্ষে রাষ্ট্র নিজেই আইনজীবী নিযুক্ত করেন, যাদের বলা হয় হয় পাবলিক প্রসিকিউটর তথা রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি)। আর সিআর মামলাগুলোতে নালিশকারীকেই ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবী নিযুক্ত করে মামলা পরিচালনা করতে হয়।
কোনো মামলায় পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব কিংবা মামলার পক্ষগণের মধ্যে সমঝোতার কারণে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে দুই ধরনের বিধান রাখা আছে।
যেসব জিআর মামলা রাষ্ট্র নিজেই পক্ষ, সেসব মামলায় পাবলিক প্রসিকিউটরের পক্ষ থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা যায়।
আর সিআর মামলায় নালিশকারী বা তাঁর পক্ষ থেকে নিযুক্ত আইনজীবী মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে পারেন ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৮ ধারার অধীনে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির পক্ষ থেকে মামলা প্রত্যাহার
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বা পাবলিক প্রসিকিউটর আদালতের অনুমতি নিয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত মোকদ্দমায়, সাধারণভাবে যেসব অপরাধে তাঁর বিচার হচ্ছে, তার যেকোনো এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে পরিচালনা থেকে সরে যেতে পারেন। অভিযোগনামা প্রণয়নের আগে সরে গেলে ওই এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে আসামির অব্যাহতি হবে; এবং অভিযোগ প্রণয়নের পর সরে গেলে অথবা এই আইন অনুসারে কোনো অভিযোগনামা প্রণয়ন করা প্রয়োজন না হলে ওই এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে আসামিকে খালাস দিতে হবে। মামলা পরিচালনা থেকে সরে যাওয়ার উপযুক্ত কারণ সম্পর্কে সরকারি বাদী আদালতকে সন্তুষ্ট করবেন। কেবল সরকারের তরফ থেকে মামলা থেকে সরে যাওয়ার আদেশ আদালত কর্তৃক অনুমতি প্রদানের জন্য যথেষ্ট কারণ হবে না।
৪৯৪ ধারার অধীনে মামলা প্রত্যাহারে বেশ কিছু বিষয় আদালতের পর্যবেক্ষণে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।
যেমন : প্রথমত, মামলা প্রত্যাহারের আবেদন কেবল পাবলিক প্রসিকিউটরের তরফ থেকেই হতে হবে। এজাহারকারী কিংবা আসামির আবেদন কিংবা সরকারের কোনো আদেশের বলে মামলা প্রত্যাহার করা যাবে না।
দ্বিতীয়ত, মামলা প্রত্যাহারের যুক্তিযুক্ত কারণ কৌঁসুলির পক্ষ থেকে আদালতের সামনে ব্যাখ্যা করতে হবে। কেবল সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে আদালত মামলা প্রত্যাহারের আদেশ দেবে না।
মামলা প্রত্যাহার সম্পর্কে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সুতরাং, আদালত যদি মামলা প্রত্যাহারের কারণ সম্পর্কে সন্তুষ্ট না হন, সে ক্ষেত্রে প্রত্যাহারের অনুমতি না দিয়ে মামলা এগিয়ে নেওয়ার আদেশ দেবেন।
মামলার ভুক্তভোগী, এজাহারকারী বা বাদী যদি মনে করে রাষ্ট্রপক্ষ অহেতুক তাদের মামলাটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সে ক্ষেত্রে ক্ষেত্র বিশেষে দায়রা জজ আদালত কিংবা হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করতে পারে।
নালিশি (সিআর) মামলা প্রত্যাহার
ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো মামলার চূড়ান্ত আদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাদী যদি ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারেন যে, তাঁকে নালিশ প্রত্যাহারের অনুমতি দেয়ার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে সেই নালিশ প্রত্যাহারের অনুমতি দেবেন এবং আসামিকে খালাস দেবেন।
এই ধারাটি শুধু নিষ্পত্তিযোগ্য মামলার ক্ষেত্রে, যা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। সে জন্য অভিযোগকারী এই ধারা অনুসারে নালিশ প্রত্যাহার করতে পারেন।
দেওয়ানি মামলা প্রত্যাহার
দেওয়ানি কার্যবিধির ২৩ আদেশের ১ নিয়ম অনুসারে, দেওয়ানি মামলা হওয়ার পর যে কোনো সময়ে বাদী সব বা যে কোনো বিবাদীর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে বা আংশিক দাবি পরিত্যাগ করতে পারেন। যে ক্ষেত্রে আদালত এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, কোনো পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য মোকদ্দমাটি ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং মামলার বিষয়বস্তুর জন্য কিংবা কোনো দাবির অংশের জন্য নতুনভাবে মোকদ্দমা করার জন্য বাদীকে অনুমতি দেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে আদালত উপযুক্ত শর্তে বাদীকে তার মোকদ্দমা প্রত্যাহার করে অথবা তার আংশিক দাবি পরিত্যাগ করার অনুমতি দিতে পারবেন এবং ওই মোকদ্দমার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বা ওইরকম আংশিক দাবি সম্পর্কে পুনরায় মোকদ্দমা করার অনুমতি মঞ্জুর করতে পারেন।
আদালতের উল্লিখিত অনুমতি ছাড়া যে ক্ষেত্রে বাদী মোকদ্দমা প্রত্যাহার করেন বা আংশিক দাবি পরিত্যাগ করেন, সে ক্ষেত্রে বাদী আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে মোকদ্দমার খরচার জন্য দায়ী হবেন এবং ওই বিষয়বস্তু বা আংশিক দাবি সম্পর্কে নতুনভাবে কোনো মোকদ্দমা দায়ের করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।
এই নিয়মের কোনো বিধানবলে আদালত কয়েকজন বাদীর মধ্যে একজনকে অন্যান্য বাদীর সম্মতি ছাড়া মোকদ্দমা প্রত্যাহার করার অনুমতি দিতে পারেন না।
প্রত্যাহারের পর একই বিষয়ে আর মামলা করা যায় না
নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মামলা প্রত্যাহার করা হলে একই বিষয়ে আবার নতুন করে মামলা করা যায় না। দেওয়ানি মামলার ‘রেস জুডিকাটা’ বা দোবারা নীতি এবং ফৌজদারি মামলার ‘ডাবল জিওপারডি’ বা দোবারা সাজা নীতির আলোকে এ ধরনের মামলাকে বাধা দেওয়া হয়। তবে উচ্চতর আদালতে রিভিশন দায়ের করে আদালতকে যদি সন্তুষ্ট করা যায়, সে ক্ষেত্রে পুনর্বিচার কিংবা পুনর্তদন্তের নির্দেশ ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত দিতে পারেন।
হাইকোর্ট বিভাগের সহজাত ক্ষমতার অধীনে এ ধরনের আদেশ দেওয়ার সুযোগ আছে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট