আইনি জিজ্ঞাসা
মা-বাবার ভরণপোষণ সম্পর্কে আইনে কী আছে
সিনিয়র সহকারী জজ রাজেশ চৌধুরী। বর্তমানে জাতীয় আইনি সহায়তা কেন্দ্র ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইডের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সন্তানের কাছে মা-বাবার ভরণপোষণ সম্পর্কে আইনে কী বলা আছে, সেই সম্পর্কে উত্তর দিয়েছেন তিনি :
‘মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব' ছোটবেলা হতেই রচনা হিসেবে আমরা পড়ে এসেছি। কিন্তু বিশ্বায়নের এ যুগে বড় হয়ে আমরা এ কর্তব্য ভুলে যাই। কয়েক দশক ধরেই এ উপমহাদেশের ঐতিহ্য যৌথ পরিবার ভেঙে পশ্চিমা অনুকরণে একক পরিবারের দিকে ধাবিত হচ্ছি, সঙ্গে পারিবারিক দায়িত্ববোধ ভুলে গিয়ে পিতামাতাকে ভরণপোষণ করতে ভুলে যাচ্ছি। অথচ জীবজগতে একমাত্র মানবসন্তানকে জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে তাকে সাবালক করা পর্যন্ত মা-বাবাকে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তাই আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বাবামাকে ভরণপোষণ করাকে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে পিতামাতার ভরণপোষণ সংক্রান্তে ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মা-বাবারা সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভের আইনি অধিকার লাভ করেছেন, যা ক্ষুণ্ন হলে যেকোনো মা-বাবা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
এ আইনে ভরণপোষণ বলতে খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গপ্রদানকে বোঝানো হয়েছে। এ আইনে প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ আইনে সন্তান বলতে সক্ষম ও সামর্থ্যবান ছেলে ও কন্যা উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। একাধিক সন্তান থাকলে সন্তানদের নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
যেসব পুত্রবধূ শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতে চায় না তাদের জন্য এ আইনে অশনিসংকেত রয়েছে। কেননা আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করিবার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একইসঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করিতে হইবে।’ যারা মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চান তারাও সচেতন হয়ে যান। কেননা তাঁদের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে- ‘কোনো সন্তান তাহার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাহার, বা ক্ষেত্রমত, তাহাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস বা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করিতে বাধ্য করিবে না।’
এ আইন অনুসারে পৃথকভাবে বসবাস করলেও মা-বাবার সঙ্গে সন্তানরা নিয়মিতভাবে দেখাসাক্ষাৎ করবে এবং যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ নিয়মিতভাবে প্রদান করবে। আবার যাদের মা-বাবা নেই কিন্তু দাদা-দাদি বা নানা-নানি আছে যাদের ভরণপোষণ করা সেই বাবা বা মায়ের দায়িত্ব ছিল তাদেরই বাবা মায়ের সে দায়িত্ব পালন করতে হবে অর্থাৎ ভরণপোষণ করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো আপনি পিতামাতাকে ভরণপোষণ দিলেন না, তো কি হবে? আইনে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে আপনার সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড, তা অনাদায়ে তিন মাস কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
আবার নিকটাত্মীয় যদি এ ক্ষেত্রে বাধা দিতে আসে তার জন্যও রয়েছে সতর্কবার্তা। কারণ সমান শাস্তি সে আত্নীয়র জন্য ও অপরাধে সাহায্যকারী হিসেবে রয়েছে, সে স্ত্রীই হোক বা অন্য কোনো আত্মীয় হোক।
যেসব মা-বাবা সন্তান হতে ভরণপোষণ পাচ্ছেন না তাঁরা কী করবেন? এ বিষয়ে ওই মা-বাবার সংশ্লিষ্ট থানার আমলি আদালতে লিখিত অভিযোগ করলে আদালত তা গ্রহণ করতে পারবেন।
এ আইনে সুবিধা হলো আদালত চাইলে এ অভিযোগ আপস নিষ্পত্তির জন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মেয়র বা কমিশনার, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার বা যেকোনো উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠাতে পারবেন। এতে উভয় পক্ষকে অবশ্যই শুনানির সুযোগ দিতে হবে।
উপরোক্ত ব্যক্তির কাছে নিষ্পত্তি করা অভিযোগ আদালতের নিষ্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে।
তবে আমরা কেউ নিশ্চয় চাইব না যে, কোনো মা-বাবাকে ভরণপোষণের জন্য তাদের সন্তানের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হতে হোক।