প্রথম পর্ব
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কী আছে?
দেওয়ানি মামলার অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে বাটোয়ারা বা বণ্টন মামলা। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে গড়পড়তা সময়ের চেয়ে অনেক বেশি লাগে। অথচ উত্তরাধিকার আইন নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে এসব মামলা হয়তো দায়েরের দরকার পড়ত না। পাঠকের উদ্দেশে আজ মুসলিম উত্তরাধিকার বা ফরায়েজ আইন তুলে ধরা হলো। কোরআনে এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত বর্ণনা আছে। পরবর্তী সময়ে হাদিস ও ইজমার মাধ্যমে ফরায়েজ আইন আরো সমৃদ্ধ হয়।
একজন মুসলমানের মৃত্যুর পরমুহূর্তেই তাঁর সম্পত্তিতে ওয়ারিশদের অংশ সৃষ্টি হয়। প্রধান শ্রেণির ওয়ারিশরা তিন শ্রেণিতে বিভক্ত—১. কোরআনিক অংশীদার, ২. অবশিষ্টাংশভোগী, ৩. দূরবর্তী আত্মীয়গণ।
কোরআনিক অংশীদার ১২ জনে সুনির্দিষ্ট। এর মধ্যে চারজন পুরুষ ও আটজন মহিলা। পুরুষরা হলো পিতা, স্বামী এবং বৈপিত্রেয় ভাই। আটজন মহিলা হলো মাতা, পিতা ও মাতার মাতা, স্ত্রী, কন্যা, পুত্রের কন্যা, আপন বোন, বিমাত্রেয় বোন ও বৈপিত্রেয় বোন। এই বার রকম কোরআনিক অংশীদারদের মধ্যে পিতা, স্বামী, মাতা, কন্যা ও স্ত্রী কোনো অবস্থাতেই উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবে না। অন্যরা কোনো কোনো অবস্থাতে বঞ্চিত হতে পারেন।
কোরআনিক অংশীদারদের অংশ বণ্টনের পর অবশিষ্ট অংশ ক্রমানুসারে লাভ করবে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে এমন নিকটবর্তী আত্মীয়রা। এদের অবশিষ্টাংশভোগী বলা হয়।
কোরআনিক অংশীদার ও অবশিষ্টাংশভোগী ব্যতীত মৃত ব্যক্তির অন্য আত্মীয়রা দূরবর্তী আত্মীয় বলে পরিচিত। কোরআনিক অংশীদার ও অবশিষ্টাংশভোগী কেউ না থাকলেই তবে এরা সম্পত্তি পেয়ে থাকেন।
এবার আমরা এই অংশীদারদের অংশের বিস্তারিত বিবরণ দেখব।
১) স্বামী : পুত্র বা পুত্রের নিম্নগামীর বর্তমানে মৃত স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামী ১/৪ অংশ লাভ করবে।
কিন্তু পুত্র বা তার নিম্নগামী পুত্রের অবর্তমানে স্বামী মৃত স্ত্রীর সম্পত্তিতে ১/২ অংশ লাভ করবে।
২) স্ত্রী : পুত্র বা পুত্রের নিম্নগামী কেউ থাকলে স্ত্রী মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে ১/৮ অংশ লাভ করবে।
কিন্তু তেমন যদি কেউ না থাকে তবে স্ত্রী ১/৪ অংশ লাভ করবে। একাধিক স্ত্রী বর্তমান থাকলে সকলে মিলে ওই ১/৪ অংশ লাভ করবে।
৩) পিতা : মৃত পুত্রের সম্পত্তিতে তিন অবস্থাতে পিতার অংশ হেরফের হতে পারে, কিন্তু সম্পত্তি হতে পিতা বঞ্চিত হবেন না। পুত্র বা নিম্নগামী পুত্রের পুত্র বর্তমান থাকলে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে পিতা ১/৬ অংশ লাভ করবে। কিন্তু শুধু কন্যা বা শুধু পুত্রের কন্যাসন্তানের বর্তমানে (কোনো পুত্র বা পুত্রের নিম্নগামী পুত্র না থাকলে পিতা প্রথমে অংশীদার হিসেবে ১/৬ অংশ পাবে। এরপর বাকিদের কাছে বণ্টনের পর যদি অবশিষ্টাংশ থাকে তবে তা অবশিষ্টাংশভোগী হিসেবে লাভ করবেন।
আর মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তানই বা তার পুত্রের নিম্নগামী কোনো সন্তানই না থাকলে পিতা শুধু অবশিষ্টাংশভোগী হিসেবেই বাকি অংশীদারদের অংশ বণ্টনের পর বাকি থাকা অংশ লাভ করবেন।
৪) পিতার পিতা বা তার ঊর্ধ্বগামী : এ ক্ষেত্রে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের সাধারণ সূত্রটা প্রথমে বলে রাখা উচিত—নিকটবর্তী ওয়ারিশের বর্তমানে দূরবর্তী ওয়ারিশ তার দ্বারা সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয় (পিতা বা নিকটবর্তী পিতার পিতা যদি থাকেন তবে পিতার পিতা কোনো অংশ লাভ করবে না)। এ ক্ষেত্রে তার অবস্থান, পিতার মতই। পিতার ক্ষেত্রে যেসব শর্তাধীনে অংশ পরিবর্তিত হয়, সেসব শর্তাধীনেই পিতার পিতা অবস্থান পরিবর্তন করে।
৫) কন্যা : কোনো পুত্র না থাকলে একমাত্র কন্যা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে ১/২ অংশ এবং একাধিক কন্যা থাকলে সকলে একত্রে ২/৩ অংশ প্রাপ্ত হবে।
কিন্তু পুত্র ও কন্যা একসঙ্গে বর্তমান থাকলে অংশীদার হিসেবে সম্পত্তি না পেয়ে অবশিষ্ট সম্পত্তিতে ২ : ১ অনুপাতে পুত্রের অর্ধেকহারে সম্পত্তি লাভ করবে।
৬) পুত্রের কন্যা/পুত্রের পুত্রের কন্যা : Muslim Family Law Ordinance, 1961-এর মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে মূল মুসলিম হানাফি আইন হতে পরিবর্তন এসেছে। এই অধ্যাদেশের ৪ ধারামতে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টনের সময় যদি দেখা যায় তার পূর্বে তার পুত্র বা কন্যার মৃত্যু ঘটে তবে ওই মৃত পুত্র বা কন্যার কোনো জীবিত সন্তান থাকলে সে তার মৃত পিতা বা মাতার অংশ লাভ করবে। এটা উদাহরণ দিয়ে বোঝান যেতে পারে।
আয়েজ উদ্দীনের মালেক জহির নামে দুই পুত্র এবং আয়েশা ও সোহাগী নামে দুই কন্যা। আয়েজ উদ্দীনের জীবিত অবস্থায় মালেক ও আয়েশা যথাক্রমে জমিলা নামীয় কন্যা ও মারুফ নামীয় পুত্র রেখে মারা যান। সে ক্ষেত্রে মালেকের অংশ তার কন্যা জমিলা ও আয়েশার অংশ মারুফ লাভ করবে। সে ক্ষেত্রে জহির ও জমিলা প্রত্যেকে ১/৩ অংশ এবং মারুফ ও সোহাগী ১/৬ অংশ লাভ করবে।
লেখক : মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক।