মানবপাচার আইন, শাস্তি ও করণীয়
বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলেছে। অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নারী-পুরুষ পাচার করা হচ্ছে। চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে; অথবা পতিতাপল্লীতে বিক্রি করা দেওয়া হচ্ছে। দালালদের খপ্পরে পড়ে এভাবে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেকেরই। দেশে মানব পাচাররোধে আইন করা হয়েছে। যে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে। নিম্নে মানবপাচার আইন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
মানব পাচার কী
কোনো ব্যক্তিকে তার দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে বিক্রি বা পাচারের উদ্দেশ্যে লুকিয়ে রাখা, আশ্রয় দেওয়া বা অন্য কোনোভাবে সহায়তা করা হলে মানবপাচার হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া মানবপাচার আইন ২০১২ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির অধিকার হরণ করে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়, দাসত্বমূলক আচরণ, পতিতাবৃত্তি বা যৌন শোষণ বা নিপীড়নের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে শোষণ বা নিপীড়ন করা হলে মানবপাচার হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত কোনো বাড়ি, স্থান বা স্থাপনা; এবং জোরপূর্বক ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা হলেও সমান অপরাধ বলে ধরা হবে।
মানবপাচার আইন
আমাদের দেশে মানব পাচারবিষয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মানবপাচার অপরাধের বিচার করা হতো।
২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রথম মানবপাচার প্রতিরোধ এবং এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। অপরাধের মাত্রাভেদে আইনের মধ্যে মানবপাচারের বিভিন্ন রকম শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
মানবপাচারের দণ্ড
এ আইনের ৬ ধারা অনুসারে মানবপাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
একই সঙ্গে আইনের ৭ ধারা অনুসারে, সংঘবদ্ধ মানবপাচার অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড।
এ ছাড়া এ আইনের ৮ ধারা অনুসারে, অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা চেষ্টা চালানোর দণ্ড হিসেবে অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে।
মানবপাচার আইন ২০১২-এর ৯ ধারা অনুসারে, জবরদস্তি বা দাসত্বমূলক শ্রম বা সেবা প্রদান করতে বাধ্য করার দণ্ড অনধিক ১২ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে।
এই আইনের ১০ ধারা অনুসারে, মানবপাচার অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে অপহরণ, চুরি ও আটক করার দণ্ড এবং মানবপাচারের অপরাধ সংঘঠনের অভিপ্রায়ে বা যৌন শোষণ ও নিপীড়নের শাস্তি অনধিক ১০ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে। নবজাতক শিশু অপহরণ বা চুরির দণ্ড অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে।
এ আইনের ১১ ধারা অনুসারে, পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো ধরনের যৌন শোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের দণ্ড অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে।
জামিন অযোগ্য আইন
এ আইনের অধীন অপরাধগুলো আমলযোগ্য, আপসের অযোগ্য এবং জামিন অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে কোনো ব্যক্তি পুলিশ অথবা ট্রাইব্যুনালের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। এ আইনের অধীন অপরাধগুলোর দ্রুত বিচারের জন্য দায়রা জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। এ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার প্রতিটি জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে ওই জেলার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল হিসেবে নিয়োগ বা ক্ষমতায়িত করতে পারবে।
মানব পাচাররোধে করণীয়
মানব পাচাররোধে মানবপাচার আইন ২০১২-এর সঠিক প্রয়োগ এবং সরকারিভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে মানবপাচারের সংখ্যা কমে আসতে পারে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ড. শাহদীন মালিক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মানবপাচারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। মানবপাচার আইনের সঠিক ব্যবহার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে তৎপর হলে মানবপাচার কমে আসবে।’
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নি এ বিষয়ে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মানুষ অভাবের তাড়নায় নারী-পুরুষ বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। কিন্তু দালালরা নারীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করছে বা বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই প্রথমে দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারিভাবে মানুষকে বিদেশে যাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত ও নিরাপদ করতে হবে। এ ছাড়া পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’