কখন যাবেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে
দেশের মানবাধিকার রক্ষা এবং তার উন্নয়নের প্রধান দায়িত্ব সরকারের। একটি রাষ্ট্র কতটা সভ্য তা পরিমাপ করা হয় ওই রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নের মাধ্যমে। এ জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজ নিজ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গঠন করে। রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত হলেও জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করেন। দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, যথাযথ পর্যালোচনা শেষে এ বিষয়ে সুপারিশ করাই এ কমিশনের কাজ। এ জন্য জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূলত পরামর্শ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিষয়ের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সরকারকে মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করেন। দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন
বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালে একটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠনের প্রথম উদ্যোগে নেওয়া হয়। একই সময়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় একটি আইনের খসড়া ও তৈরি করা হয়। কিন্তু এরপর দীর্ঘ এ বিষয়ে আর তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। অবশেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০০৭-এর মাধ্যমে ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রথম একটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন চেয়ারম্যান ও দু্জন সদস্যকে নিয়ে ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর এ কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে অধ্যাদেশকে বৈধতা না দিয়ে জাতীয় সংসদ ২০০৯ সালের ২২ জুন একজন চেয়ারম্যান, একজন সার্বক্ষণিক সদস্য এবং অন্য পাঁচ অবতৈনিক সদস্য নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে সাত সদস্যবিশিষ্ট মানবাধিকার কমিশন পুনর্গঠিত হয়।
মানবাধিকার কমিশনের এখতিয়ার
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এখতিয়ার ব্যাপক। বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন এবং বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চূক্তিগুলো এ কমিশনের এখতিয়ারে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকায় বলা হয়েছে-যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য, তাই মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কমিশনের প্রধান এখতিয়ারগুলো হচ্ছে :
১. কমিশন যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগের তদন্ত করতে পারবে।
২. রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে যেকোনো বিষয়ে কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা না হলেও কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ গ্রহণ করতে পারবে।
৩. জেলখানা, থানা হেফাজত ইত্যাদি আটকের স্থান পরিদর্শন করে সে সবের উন্নয়নে সরকারকে সুপারিশ প্রদান।
৪. সংবিধান অথবা দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় গ্রহীত ব্যবস্থাগুলো পর্যালোচনা করে এর কার্যকর বাস্তাবায়নের জন্য সরকার সুপারিশ করবে।
৫. মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দলিল বিষয়ে গবেষণা করা এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সুপারিশ প্রদান।
৬. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে দেশীয় আইনের সামঞ্জস্য বিধানের ভূমিকা রাখা।
৭. মানবাধিকার বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা।
৮. আপসের মাধ্যমে নিষ্পত্তিযোগ্য কোনো অভিযোগ মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা।
৯. মানবাধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যসহ অন্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান।
পুনর্গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দায়িত্ব
পুনর্গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই প্রথম যে কাজ হাতে নেয়; তা হচ্ছে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা। মানবাধিকার কমিশন বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন একজন বিশেষজ্ঞের সহায়তায় কৌশলপত্রটির খসড়া তৈরি করা হয়। খসড়া কৌশলপত্রে ১৬টি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কৌলশপত্রটি চূড়ান্ত করার আগে এর ওপর বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে শ্রেণীপেশার মানুষের মতামত সংগ্রহ করে কৌশল পত্রটি চূড়ান্ত করা হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে অভিযোগ
জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নারী, পুরুষসহ যেকোন বয়সের দেশি বা বিদেশি যেকোনো ব্যক্তি কমিশনের অভিযোগ করতে পারেন। অর্থাৎ গ্রামের বা শহরের, সমতল বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, ধনী, গরিব, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষিত অথবা যে কেউ কমিশনের অভিযোগ করতে পারবে। পরিস্থিতির আলোকে কমিশন নিজেও অভিযোগ গ্রহণ করতে পারবে।
কী ধরনের অভিযোগ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে যে অধিকারগুলো সব নাগরিককে দেওয়া হয়েছে, তার লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি হলে বা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বর্ণিত অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করা যায়। কেউ যদি মনে করে মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে তাঁর জীবন, সমতা ও মর্যাদার যে অধিকার পাওনা আছে, তা ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিংবা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বা কোনো জনসেবক কর্তৃক মানবাধিকার (জীবন, সমতা ও মর্যাদা সংক্রান্ত অধিকার) লঙ্ঘন করা হয়েছে বা লঙ্ঘনের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে কিংবা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বা কোনো জনসেবা কর্তৃক মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ করা যায়।
কীভাবে অভিযোগ দাখিল করবেন
কমিশনের নির্ধারিত ফরমে অথবা সাদা কাগজে হাতে লিখে বা টাইপ করে কমিশনের অফিসে নিজে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে অথবা ডাক/কুরিয়ার সার্ভিস অথবা ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ পাঠানো যায়। অভিযোগের সাথে অন্যান্য কাগজপত্র, ছবি, অডিও-ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদি সংযুক্ত করা যেতে পারে।
কমিশনের করণীয়
১.কমিশন অভিযোগকারীর বা অভিযুক্ত কারো পক্ষে নয়, বরং নিরপেক্ষভাবে অভিযোগ নিষ্পত্তির উদ্দেশে উভয়ের জন্যই কাজ করা।
২. অভিযোগ করা বা অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া, অভিযোগ করার আগে পরার্মশ করা ইত্যাদির জন্য কোনো খরচ করার প্রয়োজন হয় না।
৩. কমিশেনর মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যেন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে নাগরিকের মর্যাদা, সম্মান, সমতা ইত্যাদির অধিকার লঙ্ঘন করতে না পারে তার প্রতি লক্ষ রেখে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন ঘটানো।