পাটের ব্যাগ ব্যবহারে বাধ্য করতে শুরু হচ্ছে অভিযান
পাটের ব্যাগ ব্যবহারে বাধ্য করতে ২০১০ সালে আইন প্রণয়ন করে সরকার। ওই আইনে কিছুটা সংশোধন আনা হয় ২০১৩ সালে। বিভিন্ন কারণে আইন বাস্তবায়নের দিকে এগোয়নি। আইন কার্যকর করতে ৩০ নভেম্বর থেকে অভিযানে নামছে সরকার। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আইন কার্যকরে এরই মধ্যে জনপ্রশাসন বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য, শিল্প, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন দপ্তরপ্রধানের সহযোগিতা চেয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তরপ্রধান ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শেষে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারীদের পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিতে আইন দ্বারা নির্ধারিত পণ্যের মোড়কের জন্য ডব্লিউপিপি (প্লাস্টিক) ব্যাগের উৎপাদন ও সরবরাহ না করা; অটোরাইস, হাস্কিং ও চাতাল মালিকদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় পাটের ব্যাগ ব্যবহার করার শর্তারোপ; শর্ত ভঙ্গ করলে লাইসেন্স বাতিল এবং ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি—এই ছয়টি পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার সময় পাটের ব্যাগ ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পরিচালক (বিপণন) কর্নেল লেলিন কামাল বলেন, ‘আগেও আমরা এমন অভিযান পরিচালনা করেছি। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচারে তা ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। এ কারণে অভিযান বেশিদূর এগোয়নি। আমরা মামলায় জিতেছি। পাটকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আবারো অভিযান শুরু হচ্ছে।’
লেলিন বলেন, ‘বস্ত্র ও পাট অধিদপ্তরের অধীনে ৩০ নভেম্বর থেকে অভিযান শুরু করবেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরই মধ্যে সারা দেশে পাটের বস্তা সরবরাহে এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলার চাহিদা অনুযায়ী ডিলারের মাধ্যমে পাটের বস্তা সরবরাহ শুরু হয়েছে। আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।’
বিজেএমসির পরিচালক এ কে নাজমুজ্জামান বলেন, ‘এবার আমরা সাফল্য নিশ্চিত করতে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছি। এ জন্য বিজেএমসি অনেক প্রস্তুতি হাতে নিয়েছে। অভিযানের পর পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে। তাই রপ্তানি কমানো হয়েছে। আর উৎপাদন অনেক বাড়ানো হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযান সফল করতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ। বহনের সুবিধার জন্য ৫০ কেজি পণ্য ধারণ করতে পারে এমন বস্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আর ৮০ কেজির বস্তাও প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ ছাড়া চাহিদামতো যেকোনো ধরনের পণ্যই সরবরাহের প্রস্তুতি রয়েছে বিজেএমসির। ক্রেতা ও এজেন্টদের চাহিদামতো ৫ ও ১০ কেজি সাইজের ব্যাগ সরবরাহের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
বস্ত্র ও পাটকল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সরকারি মিলের মাধ্যমে প্রতিদিন পাঁচ লাখ ব্যাগ উৎপাদন করা হচ্ছে। নভেম্বরে বিজেএমসির লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি ব্যাগ উৎপাদন করা। বর্তমান উৎপাদনের এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজেএমসি জানায়, অভিযান সফল হলে দেশে এ বছর বিভিন্ন কাজে ৪৫-৫০ কোটি ব্যাগ দরকার হবে। তবে আগামী বছর চাহিদা কিছুটা কমে আসবে। সরকারিভাবে ২২টি মিলে ২৫ কোটি ব্যাগ সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সারা দেশে জেলা প্রশাসকদের সাহায্যে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে এ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
গত ২৫ অক্টোবর থেকে অভিযান পরিচালনার কথা ছিল। পরে এটা পেছানো হয়। আইন বাস্তবায়নে সরকার এবার অভিযান অব্যাহত রাখতে চায়।
প্রাথমিকভাবে ছয়টি পণ্যে মোড়কীকরণে পাটের ব্যাগের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে পর্যায়ক্রমে আরো পণ্য এর আওতায় আনা হবে। এখন মানুষের আস্থা বাড়ানোর কাজকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ অভিযানকে সফল করতে কয়েকটি মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করবে। এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যের মোড়কীকরণ ও প্যাকিংয়ে পাটের ব্যাগ ব্যবহার না করলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এ ছাড়া এ ছয়টি পণ্য যাঁরা আমদানি-রপ্তানি করেন, তাঁরা আইনটি অনুসরণ না করলে এলসি বাতিল হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেতে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে মুচলেকা দিতে হবে যে, তারা ডব্লিউপিপি ব্যাগ উৎপাদন ও সরবরাহ করবে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা রাইস মিল মালিক, চাতাল মালিক, আড়ত মালিক, খাদ্য বিভাগের লাইসেন্সের মাধ্যমে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদেরও এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকা নৌ ও স্থলবন্দর, ফেরিঘাটে পণ্যদ্রব্য ওঠানামায় এ আইন বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
এ ছাড়া গত ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক এক নির্দেশনায় সব ব্যাংকের শাখাকে জানিয়েছে, ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি ব্যবসায়ীরা পাটের ব্যাগ ব্যবহার না করলে ব্যাংকঋণ পাবে না।
আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে তারা যাতে পাটপণ্য ব্যবহার করে, সেদিকে স্ব-স্ব মন্ত্রণালয় কাজ করার আশ্বাস দিয়েছে।
পুরান ঢাকার বাদামতলীর চালের পাইকারি আড়তদার মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘চটের বস্তায় আমাদের আপত্তি নেই। আগে চটের বস্তাতেই চাল আমদানি করতাম। মিলমালিকরা যে বস্তা দেবে, আমরা তাতেই আনতে বাধ্য। আমরা অভিযানের ব্যাপারে কোনো কিছুই জানি না। তবে ঢাকার বাইরে এমনটি শুরু হওয়ার কথা শুনেছি। বস্তায় খরচ বেশি হলে আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা বেশি নেব। আমাদের কোনো লোকসান নেই।’
বিজেএমসি সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে পাটের ব্যাগের বাজারদর ঠিক রাখতে বেসরকারি পাটকল মালিকদের সঙ্গেও পাটকল করপোরেশন বৈঠক করেছে। ১০ শতাংশ কমিশনে ডিলার নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারা দেশে ডিলারদের চাহিদা অনুযায়ী তাদের এলাকার কাছাকাছি মিল থেকে মাল সরবরাহের অর্ডার দেওয়া হচ্ছে।
চাষিদের পাটের উৎপাদন নিশ্চিত, পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও সম্প্রসারণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনে সরকারি ও বেসরকারি খাতে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০ কেজির চেয়ে বেশি পণ্যের মোড়কীকরণের ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য।
পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ (সংশোধিত)-এর ১৪ ও ১৫ ধারার বিধান অনুযায়ী, ‘কোনো ব্যক্তি এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি দ্বারা নির্ধারিত পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার না করে কৃত্রিম মোড়ক দিয়ে কোনো পণ্য বা পণ্যসামগ্রী মোড়ক, বিক্রি, বিতরণ বা সরবরাহ করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর এই অপরাধ যদি কেউ আবার করে, তাহলে যে দণ্ড আছে তার দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’