আকস্মিক ঘটনা কেন দুর্যোগ হয়?

Looks like you've blocked notifications!

ইংরেজি ভাষায় রচিত সামাজিক বিজ্ঞানের বই-পুস্তকে ডিজাস্টার (দুর্যোগ) অধ্যয়নে কিছু সহযোগী শব্দ, যেমন—‘হ্যাজার্ড’, ‘রিস্ক’ ও ‘ভালনারবিলিটি’ অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। তবে প্রতিটি শব্দের রয়েছে সাধারণ সংজ্ঞা ও তাত্ত্বিক বিতর্ক। কিন্তু বাংলা ভাষায় এই শব্দগুলো ব্যবহারে ও বোঝাপড়ায় আমরা তেমন একটা সতর্ক থাকি না। কোনটি আকস্মিক ঘটনা বা কোনটি দুর্যোগ, তা সম্পর্কে আমাদের সাধারণ জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এর বড় একটি কারণ হলো, আমাদের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে এগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কয়েকটি ডিসিপ্লিনে এগুলো সম্পর্কে পাঠ করা হয়। যদিও বাংলাদেশের মানুষ বহু যুগ ধরেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। দেশটি ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই দুর্যোগপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপত্তি, যেমন—বন্যা, অনাবৃষ্টি বা খরা, সাইক্লোন ও শৈত্যপ্রবাহ নিয়মিতভাবে ঘটে। তাই দুর্যোগের ওপর সাধারণ জ্ঞান আমাদের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে।

সাধারণত বর্ষাকাল এলে আমরা দুর্যোগ শব্দটি খুব বেশি শুনি। কারণ, এই সময় বন্যা হয়। বন্যাসৃষ্ট দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষ বিপদের সম্মুখীন হয়। সম্প্রতি আমরা একটি নতুন ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছি। যেটিকে বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ মহামারি। এটিকে কেন ‘দুর্যোগ’ বলা হচ্ছে? এটিকে কেন সরলভাবে ‘আকস্মিক ঘটনা’ বা ‘আকস্মিক বিপত্তি’ বলা হচ্ছে না? সামাজিক বিজ্ঞানের তাত্ত্বিকদের মতে, ভূমিকম্প একটি আকস্মিক ঘটনা বা ইভেন্ট বা বিপত্তি। এটি তখনই দুর্যোগ, যখন ভূমিকম্পটি জীবন, সম্পদ ও জীবিকার ওপর আঘাত আনে। অর্থাৎ মানুষকে বিপদে ফেলে। একইভাবে কোভিড-১৯ যেহেতু মানুষের জীবনকে বিপদাপন্ন করেছে, তাই এটিকে দুর্যোগ বলা হচ্ছে। যদি কোনো মানুষকে আক্রান্ত না করত, তাহলে এটিকে দুর্যোগ বলা হতো না। দুর্যোগের অভিজ্ঞতা বয়স, শ্রেণি ও জেন্ডারভেদে ভিন্ন। সামাজিক বিজ্ঞানীরা ভিন্ন অভিজ্ঞতার কারণগুলোর ওপর বেশি মনোনিবেশ করেন।

ধরা যাক, পদ্মা নদীর পানি বেড়ে তা নদীটির তীরবর্তী দুটি গ্রামে প্রবেশ করেছে। তন্মধ্যে, একটি গ্রামের রাস্তা কর্দমাক্ত হয়েছে, জমির ফসল নষ্ট হয়েছে ও ঘরবাড়ি ভেঙে গিয়েছে। ফলে মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য অনিরাপত্তার সম্মুখীন হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই গ্রামটির জন্য নদীর পানি বৃদ্ধি হওয়াটি ছিল দুর্যোগ। অন্য গ্রামটির রাস্তা উঁচু ও পাকা, ড্রেন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার কারণে নদীর বর্ধিত পানি জমির ফসলে প্রবেশ করেনি এবং ঘরবাড়ির অবস্থান পরিকল্পিত ও উঁচুতে হওয়াতে তা নষ্ট হয়নি। ফলে দ্বিতীয় গ্রামটির অধিবাসীদের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি। এই গ্রামটির জন্য বন্যার পানিকে দুর্যোগ বলা যাবে না। এই গ্রামটির জন্য বন্যার পানি কেবলই একটি প্রাকৃতিক ঘটনা বা বিপত্তি বা ইভেন্ট (হ্যাজার্ড), যা হঠাৎ করে এসেছে। কিন্তু প্রথম গ্রামটির বেলায় এই বন্যার পানিকে বলা হবে—প্রথমত, হ্যাজার্ড এবং দ্বিতীয়ত, ডিজাস্টার বা দুর্যোগ।

এখন প্রশ্ন হলো, কোভিড-১৯ কি সবার জন্যই দুর্যোগ? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। কারণ, ঘটনাটি এখনো চলমান। তবে ইতোমধ্যে দেখা গেছে ভাইরাসটি দিনমজুর ও অন্যান্য নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। দরিদ্ররা ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ করছে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা ১০ ঘণ্টার বেশি হেঁটে ঢাকা এসেছেন তাঁদের চাকরি রক্ষা করতে। এতে তাঁরা যেমন করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তেমনি অন্যকেও আক্রান্ত করতে পারেন। তাঁদের জন্য এটি অবশ্যই দুর্যোগ। কিন্তু এই দুর্যোগের জন্য কি তাঁরা দায়ী? সহজ উত্তর : না। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোই এর জন্য দায়ী।

দুর্যোগ বিষয়ে গবেষকগণ যুক্তি দেন, দুর্যোগ তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে, যাঁরা আগে থেকেই অরক্ষিত (ভারনারেবল), দরিদ্র, কম সম্পদের মালিক ও অনিরাপদ স্থানে বসবাস করছে। দরিদ্র ব্যক্তি, পরিবার বা কমিউনিটির ওপর যদি আকস্মিক ঘটনা (হ্যাজার্ড) আঘাত আনে, তাহলে দুর্যোগ ঘটে। এককথায়, দুর্যোগ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নির্মিত, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এককভাবে দায়ী নন। দুর্যোগের ফলাফল অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে ভিন্ন হয়। যেমন—এটি সহজেই অনুমেয় যে একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত দরিদ্র ব্যক্তির পক্ষে মাসের পর মাস উপার্জন না করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কষ্টকর। তাই দুর্যোগ বিশেষজ্ঞগণ আকিস্মক ঘটনাকে নয়, বরং যেসব সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, সেগুলো নিরসনের জন্য পরামর্শ দেন। এই বিষয়গুলো দুর্যোগ সম্পর্কে খুবই সাধারণ পর্যায়ের জ্ঞান, যা সবার জানা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ দুর্যোগ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, সমাজে বিদ্যমান আয়বৈষম্য ও চিকিৎসা-বৈষম্য দূর করতে হবে। তাহলে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা সহজতর হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়