আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

Looks like you've blocked notifications!

মনে আছে নিশ্চয়ই, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত?’ ফেসবুকে এমন এক  প্রশ্ন করে উপাচার্যের রোষানলে পড়তে হয়েছিল এক ছাত্রীকে। এর পর বহু অন্যায় আর জালিয়াতি প্রমাণ হলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে উপচার্যকে রাতের অন্ধকারে পালাতে হয়েছিল।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক নিন্দিত হয়েছেন আর রিমোট ভিসি হিসেবে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এরই মধ্যে দূরশিক্ষণের মতো দূর-প্রশাসন পরিচালনায় রেকর্ড গড়েছেন। বহুদিন আলোচনায় থেকে এখন কিছুটা আড়ালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এবার নতুন করে আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একাডেমিক গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের পদাবনতি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি পিএইচডি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুককেও একই শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

নাম তিনজনের, কিন্তু বেশি আলোচনায় সামিয়া রহমান, কারণ তিনি একজন গণমাধ্যম তারকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির পর বিষয়টি যায় পরবর্তীতে গঠিত ট্রাইব্যুনালে, সেখান থেকে সিন্ডিকেটে। আর্টিকেল ছাপার আগে একজন রিভিউয়ার থাকেন এবং যিনি ছাপেন, অর্থাৎ সম্পাদক; তাঁদেরও দায়দায়িত্ব থাকে এসব বিষয়ে। তবে সিন্ডিকেট তাঁদের ব্যাপারে কী বলল সেটা জানা গেল না।

পুরো বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়া। আমাদের এখানে বলার কিছু নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে শুধু নয়, এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে দেশের মানুষের করের অর্থে পরিচালিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে চলছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আসে।

দু-একটি বাদ গেলে প্রায়ই অনিয়ম, দুর্নীতি আর সহিংস ছাত্র রাজনীতি আর শিক্ষক রাজনীতির আলোচনায় উঠে আসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ। সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়। এতে করে যে এসব উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঠন-পাঠনের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নিশ্চয়ই নেই। এমন চলতে থাকলে একদিন প্রতিষ্ঠানসমূহ সত্যিই তলিয়ে যাবে, এমন আশঙ্কা শুধু সাধারণ মানুষের নয়, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বিশিষ্ট শিক্ষকদেরও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অনেক অর্জন আছে। এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে, ভাষাসংগ্রামে, গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে এঁদের ভূমিকা অস্বীকার কোনো উপায় নেই। কিন্তু একাডেমিক অর্জনে যদি তারা পিছিয়ে পড়ে, তাহলে উদ্বেগ বাড়বেই। সারা বিশ্বে একাডেমিক র‌্যাঙ্কিংয়ে কেন ভালো অবস্থায় নেই, সেই উত্তর বা ব্যাখ্যা আমরা আর চাই না। কিন্তু উচ্চশিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানগুলো, যাদের আমরা জাতির বিবেক বলে জানি, তাদের শিক্ষকেরা, উপাচার্যেরা যদি নৈতিকতা বা যোগ্যতার মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হন, তখন দুঃখ করা ছাড়া উপায় থাকে না।

উচ্চশিক্ষার মান কী ও কেমন হওয়া উচিত, এ নিয়ে তর্ক অনেক। উৎকর্ষ বলতে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত আছে অনেক শিক্ষকের। আমাদের অনেক শিক্ষকই পৃথিবীর সেরা একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এসেছেন। তাঁরাই ভাববেন শিক্ষার মান কী করে উন্নত করা যায়। কিন্তু আমজনতার  জায়গা থেকে আমরা বলতে পারি, মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সবার আগে যেটা করতে হবে, কোনোরকম আপস না করে ভালোকে ভালো আর খারাপকে খারাপ বলার অভ্যাস করতে হবে এবং সেসব আলোচনা ও সমালোচনাকে গ্রহণও করতে হবে। পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি, ছাত্রনেতাদের চাঁদাবাজি, শিক্ষকদের একটা অংশের অতি রাজনীতি আলোচনায় আসবেই, যেমন করে আসে কোনো এক উপাচার্য দূর মফস্বল শহরের ক্যাম্পাসে না গিয়ে কেন উড়োজাহাজে ঘোরেন সেই প্রশ্ন। আলোচনায় আসবেই আরো অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির অভিযোগও।

ঢালাও সমালোচনা কাম্য নয়। এখনো তেমন শিক্ষক অনেক, যাঁরা এত অধঃপতনের মাঝেও একাডেমিক থাকেন, বর্ণদল করেও যাঁরা নৈতিকতার পথে চলেন।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। একদিকে রাজনীতি আতিশয্যে পরিণত হয়েছে ভোটার নিয়োগ পদ্ধতি। ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে সাধারণত মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সহিদুজ্জামানের একটা লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘বিশ্ববিদ্যালয় চাকরির কোনো ক্ষেত্র নয়; এটি  শিক্ষা ও গবেষণার জায়গা। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে চাকরির বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ। কিন্তু বাড়ছে না শিক্ষার গুণগত মান এবং তৈরি হচ্ছে না দক্ষ ও যুগোপযোগী গ্র্যাজুয়েট। গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। সব মিলিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা লেজেগোবরে।’

শিক্ষক নিজে উঁচু মানের হবেন, ছাত্রছাত্রীর মধ্যে উঁচু মানের জ্ঞান বিতরণ করবেন, এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু তার চেয়েও বড় চাওয়া, শিক্ষক এমন নৈতিক মানের হবেন, শিক্ষার্থীরা তাঁকে সারা জীবনের জন্য রোল মডেল মনে করবে। অধ্যাপকেরা পড়াবেন তাঁদের ক্ষমতা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা পড়বে তাদের সাধ্যমতো। ক্যাম্পাস তৈরি করবে একটা পরিবেশ, যাতে ছাত্রছাত্রীরা নিজেকে তৈরি করে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষম নাগরিক হিসেবে। আমাদের অনেক ভবন আছে, বেতনকড়ি, সুযোগ-সুবিধাও উন্নতির দিকে। কিন্তু যা নেই, তা হলো শিক্ষাদানের উপযুক্ত কাঠামো, গবেষণার পরিবেশের উন্নতির কোনো ভাবনা। শিক্ষকসমাজের মধ্যে এমন মানসিকতা প্রোথিত করা হয়েছে, তারা শিক্ষার মান বিষয়ে ততখানি গভীর ভাবনায় থাকেন না, যতখানি থাকেন নিজস্ব উন্নয়ন নিয়ে।

এ জায়গা থেকে ফিরতে হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একই মানে উন্নীতকরণের প্রচেষ্টা নিতেই হবে। এটা করতে পারলে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান উন্নত হবে। গবেষণার জন্য বরাদ্দ তাদের চাহিদা অনুযায়ী দিতে হবে। সবার আগে দরকার মনের শুদ্ধতা। আমরা বিশ্বাস করি, প্রকৃত শিক্ষাবিদ, নিজের ইচ্ছায় উচ্চশিক্ষিত যেসব জ্ঞানী-গবেষক, যাঁরা উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন বুঝবেন, তাঁদের হাতে শিক্ষার গুণগত মান কখনোই মার খাবে না। দরকার শুধু সেই পরিবেশটা।

লেখক : সাংবাদিক