আমৃত্যু সংগ্রামী কামাল লোহানী

Looks like you've blocked notifications!

চলে গেলেন বাংলাদেশের বিপ্লবী সংস্কৃতির অন্যতম পথিকৃৎ কামাল লোহানী। কিছু সময়ের জন্য বিপ্লবী বা হঠাৎ-বিপ্লবীর সন্ধান হয়তো অনেক মিলতে পারে। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিপ্লবের প্রতি আস্থা রেখে লড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বিরল। কামাল লোহানী সেই বিরল মানুষের একজন। তিনি বাংলার মানুষের অধিকার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পূর্বপুরুষদের সংগ্রামের উত্তরাধিকারকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে আমৃত্যু লড়ে গেছেন। তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।

লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় দুই দশকের অধিক সময় হলেও তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছি মূলত ২০১২ সালে, তিনি উদীচীর সভাপতি হওয়ার পর। এই আট বছরে দেখেছি কত সহজে তিনি মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। তিনি জনগণে বিশ্বাস করতেন, মনে করতেন গণশক্তির প্রবল জোয়ারের কাছে কোনো শক্তিই টিকতে পারে না। গণশক্তির সেই প্রবল জোয়ার সৃষ্টি করতে হলে তার চেতনাকে শাণিত করে তুলতে হয়। সেটা পারে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

কামাল লোহানীর অনেক পরিচয়। তিনি রাজনীতি-সংস্কৃতি-সাংবাদিকতাসহ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ অসংখ্য কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ক্ষেত্র সংস্কৃতি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতির পাঠ শুরু হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া ছায়ানটের প্রথম সাধারণ সম্পাদক নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে তাঁর হাল ধরেন কামাল লোহানী। এরপর ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী।

১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৫ মে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, যার অন্যতম সংগঠক ও বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী। লোহানী ভাই যুক্ত ছিলেন গণশিল্পী সংস্থার সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী সোমেন চন্দকে যখন মানুষ ভুলতে বসেছে, ঠিক সে সময় সোমেন চন্দ চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত থেকে তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি কাজের প্রথম সুযোগ হয়।

তিনি ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত উদীচীর সভাপতি ছিলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। এ সময়ে তাঁর আরো কাছাকাছি হয়েছি। তাঁর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা গণজাগরণ আন্দোলনে সামনে থেকে লড়াই করেছে উদীচী। ২০১৫ সালে আমরা আয়োজন করতে সক্ষম হই ‘দক্ষিণ এশীয় সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সাংস্কৃতিক কনভেনশন’, গঠিত হয় দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক মঞ্চ, এ সময় উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা ‘সত্যেন সেন স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশিত হয়। তাঁরই অনুপ্রেরণায় দেশের গণসংগীতের দিকপালদের নিয়ে উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘গণসংগীতের গণনায়ক’ প্রকাশসহ অসংখ্য কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

গত ২৪ মে ছিল সোমেন চন্দের শততম জন্মবার্ষিকী। কথা ছিল সোমেনের জন্মশতবার্ষিকী আমরা সাড়ম্বরে উদযাপন করব। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি এবং লোহানী ভাই অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমরা দিনটি উদযাপন করতে পারলাম না। তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, সোমেন চন্দকে যেখানে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, সেখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে যাওয়ার। নানাভাবে চেষ্টাও করেছেন তিনি। আমার ওপর কিছুটা দায়িত্ব ছিল একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের। ইতোমধ্যে আমরা প্রায় ৪০টির মতো লেখা সংগ্রহ করে তা সম্পাদনার কাজও শেষের দিকে।

তবে ২৪ তারিখে সোমেন চন্দের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে যখন ফেসবুকে দিই, তখন তিনি হাসপাতালের বিছানায়। তাঁর কন্যা বন্যা লোহানীর আইডি থেকে তথ্যচিত্রটি দেখে ফোন করে আমাকে জানিয়েছিলেন, যখন আমরা কিছুই করতে পারছি না, তখন তুমি একটি দারুণ কাজ করলে। লোহানী ভাই, আপনাকে কথা দিতে পারি স্মারকগ্রন্থটিও প্রকাশিত হবে।

তিনি সত্য বলতে কখনো দ্বিধা করতেন না এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ; তার জন্য সব সময় সোচ্চার থেকেছেন। তাঁর এ সময়ে চলে যাওয়াটা আমাদের আরেক মহামারির মধ্যে ফেলে দিল। আমরা হারিয়ে ফেললাম শির উঁচু করে কথা বলা রাজপথ-কাঁপানো অকুতোভয় এক সংস্কৃতি-সংগ্রামীকে। তবে আমি বিশ্বাস করি, তাঁর রেখে যাওয়া কাজ অনন্তকাল আমাদের শক্তি ও সাহস জোগাবে। তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন চিরভাস্মর হয়ে।

লেখক : সহসাধারণ সম্পাদক, উদীচী