ইউক্রেন নয়, রাশিয়ার টার্গেট আরও বড়
একটি ঘটনা বা অবস্থার দৃশ্যমান কিছু উপাদানকে ঠিকভাবে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ঘটনার অভ্যন্তরীণ অনেক জটিল ও গভীরতর মাত্রাগুলোকে স্পর্শ করা যায় এবং ঘটনাটির ‘কার্যকারণ’ সম্পর্কেও বোঝাপড়া তৈরি হয়। তবে, এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ে অতিপ্রয়োজনীয় এক বা একাধিক উপাদান বাদ পড়ে যায় কিংবা ভুলভাবে ব্যাখ্যা হয়, ফলে পুরো অনুমান ভুল হয়ে যায়। এই ঝুঁকি নিয়েই নিচের এ সেমিওটিক পর্যবেক্ষণ।
গোটা বিশ্ব বেশ ক’বছর ধরেই ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার এ হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল। এটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল যে, তারা হামলা করবে। কারণ, ইউক্রেনে ন্যাটোর হস্তক্ষেপ এবং আমেরিকার নিরাপত্তা-বাহানায় ক্রমাগত রাশিয়াবিরোধী অবস্থান। ইউক্রেনে ন্যাটোর শক্তি সঞ্চয় ঘটলে রাশিয়া রিটালিয়েট করবেই। তাই ক্ষমতাসীন তিন গোষ্ঠীই—পশ্চিমা, রুশ ও ইউক্রেনীয়—একে অপরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল এমনটা ঘটাবার জন্য। মার্কিন নেতৃত্বে আজ যারা হামলার প্রতিবাদ করছে এবং যারা হামলা করছে, তারা উভয়ই সমানভাবে দায়ী।
তবে সবচেয়ে বেশি দায় ইউক্রেনের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর। কেননা তারাই পরোক্ষভাবে এই হামলাকে আহ্বান করেছে এবং ইউক্রেনের জনসাধারণের অশেষ দুর্ভোগ ও ক্ষতির কারণ হয়েছে।
রাশিয়ার এ আক্রমণের বৈশ্বিক প্রভাব হতে পারে কয়েক ধরনের। প্রথমত, এই হামলার ফলে সবচেয়ে লাভবান হবেন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। মোটাদাগে এটা পুঁজিপতি গোষ্ঠীর লাভ। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া আপাত নিন্দার লক্ষ্য হলেও দিনশেষে এটা তার লাভের জায়গা, বিভিন্নভাবে। রাশিয়াকে আগ্রাসী মনে হলেও তার জিওপলিটিক্যাল অবস্থান, তেল-ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে তার ভূমিকা, ক্ষমতা লগ্নির মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব ইত্যাদি চিন্তা করলে রাশিয়ার এ আগ্রাসন সহজেই অনুমেয়। জাতি রাষ্ট্রব্যবস্থা-কাঠামোতে এই ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা-চেষ্টা অনিবার্য। তৃতীয়ত, পৃথিবীর বর্তমান ক্ষমতা-কাঠামোতে রাশিয়া ও চীন মিলে যে জায়গাটা তৈরি করেছে আমেরিকার মনোপলিতে পালটা-আক্রমণ করার, এগুলো কিন্তু সেসবেরই অংশ।
এই আক্রমণ শুধু ইউক্রেনেই হয়েছে তা কিন্তু নয়। আরও অনেক দেশেই এ আক্রমণ হতে পারে বা হবে। এটা চীন বা রাশিয়া যে কেউ করতে পারে। তাইওয়ান তো একেবারে টার্গেটেড হয়েই আছে। হংকং তো দখলই হয়ে গিয়েছে। আমাদের মতো দেশগুলো যে খুব ভালো আছি তা কিন্তু না। আমরাও যেকোনো সময় আক্রমণের শিকার হতে পারি। এটা সরাসরি বা পরোক্ষভাবেও হতে পারে। তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে না। কারণ, পুঁজিবাদী কাঠামোর আরও কিছুদিন টিকে থাকার ক্ষমতা রয়েছে। যত দিন এটা টিকে থাকবে তত দিন বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলায় ন্যাটোর ভূমিকা স্পষ্ট। ন্যাটো হচ্ছে একটি মিলিটারি অরগানাইজেশন। এরা কখনো পজিটিভ কোনো রুল প্রয়োগ করে না। তারা চেয়েছিল যেন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে। এখন তা-ই হয়েছে। তাছাড়া রাশিয়া তো গোটা দেশ দখল করবে না। ওই দেশটির রাজধানী, বিমানবন্দর ও সম্প্রচার কেন্দ্রগুলো আগে দখল করবে। ইতোমধ্যে কিয়েভ ও তার পার্শ্ববর্তী একটি বিমানবন্দর দখলে নিয়েছেও রুশ সেনারা।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি ১৫-১৬ টা দেশকে অনুরোধ করেছেন, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। এটা তো তার আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল, তারা কেন আসবে? কারণ, রাশিয়ার তেল না হলে তো গোটা ইউরোপ মুখ থুবড়ে পড়বে। রাশিয়া এখন সেই গেমটা খেলছে। সে ভালোভাবেই জানে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তার কী ক্ষতি হবে এবং যারা নিষেধাজ্ঞা দেবে তাদের কী ক্ষতি হবে। তাছাড়া রাশিয়া কিন্তু একা নয়। ইরান তাদের শক্ত সমর্থক। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঝামেলা করতে গেলে সৌদি আরবসহ ওই বলয়ের সমস্যা হবে। আর রাশিয়াকে চীন কিছু বলবে না। হয়তো চীনের সঙ্গে কথা বলেই তারা এটা করেছে। তাই চীন এখন পুরোপুরি নিশ্চুপ।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব না। আমেরিকার বিরুদ্ধেও না। কারণ, তাদের ভেটো ক্ষমতা। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে পারবে না, এটা সবাই জানে। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উচিত ছিল আরও ইন্টিলিজেন্ট হওয়া। তাকে মাঝখানে রেখে এ খেলাগুলো খেলা হচ্ছে, এগুলো বুঝতে পারা।
ইউক্রেনের সাধারণ জনগণের মধ্যে কয়েকটি ভাগ রয়েছে। তাদের একটা অংশ রাশিয়ার সমর্থক। যাদের আমরা রুশ সাহিত্যিক বলে জানি তাদের অনেকেই কিন্তু ইউক্রেনিয়ান। লম্বা সময় ধরে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। তারা সেভাবেই দেখেছে। ইউক্রেন যে আলাদা দেশ হবে, তারা সেটা চিন্তাও করেনি। অনেক আগে থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ। অধিকন্তু ইউক্রেন কিন্তু রাশিয়ার লক্ষ্য না। তাদের লক্ষ্য আরও বড়।
এ ঘটনায় বাংলাদেশের ওপর প্রভাব পড়ার দুই তিনটা জায়গা আছে। প্রধান প্রভাব পড়তে পারে তেলের ওপর। কারণ, রাশিয়ার তেল নিয়ে সমস্যা হলে পৃথিবীজুড়ে তেলের দাম ভয়ংকরভাবে বেড়ে যাবে। গোটা বিশ্ব তেলের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। আর তেলের দাম বেড়ে গেলে আমাদের মতো ছোট দেশগুলোতে প্রভাব তো পড়বেই। দ্বিতীয়ত, চীন ও রাশিয়ার বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যদি এ হামলা হয়ে থাকে তাহলে চীন দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দিকে এগোবে। আর তখন যদি চীন আগ্রাসী মনোভাব দেখায় তাহলে বাংলাদেশ হটস্পট হয়ে উঠবে। কারণ, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছে। সর্বোপরি, গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি অস্থির হয়ে পড়ে তাহলে আমাদের মতো দেশগুলোতে সেটা অসহনীয় জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের অবস্থা তৈরি হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়