ইউক্রেন-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব : বিশ্বের কাঠামো পরিবর্তন হতে পারে
ইউক্রেন-রাশিয়া হামলার কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবিত হবে। সামরিক প্রভাব এখন একটা ব্যালেন্সের দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অলরেডি তেলের মূল্য বেড়ে গেছে একশ ডলার। বিশ্বের যে স্টক মার্কেট, সেটা ফ্লাকচুয়েট করা শুরু হয়ে গিয়েছে। কাজেই এর প্রধান প্রভাবটা পড়বে ইউরোপে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে যারা যুক্ত রয়েছে, তাদের ওপর। আমাদের মতো দেশগুলোতে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব না পড়লেও পরোক্ষভাবে পড়বে। কারণ, যখন জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাবে তখন আমাদের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর ওপরে এর প্রভাব পড়া শুরু হয়ে যাবে।
তুরস্কের দিক থেকে রাশিয়াকে প্রতিহত করার জন্য ইউক্রেন চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তুরস্ক সেই সাপোর্টটা এখনও দেয়নি। তারা আক্রমণ বন্ধ করতে বলেছে। তবে তুরস্ক তাদের বসফরাস প্রণালী এবং রাশিয়ার যে এন্টোনিস্ট প্রণালী, সেটা কিন্তু তারা বন্ধ করেনি। আজকে ন্যাটো যে বৈঠক করেছে, সেখান থেকে বোঝা যায়, তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার দিকেই যাচ্ছে। এখন সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে ভারত ও চীনের একটা কানেক্টিভিটি আছে। এখন চীন, ভারত ও রাশিয়া কিন্তু একটা বেল্ট। ওদিকে ফ্রান্স অলরেডি মুভ করেছে। বর্তমানে ন্যাটো কিন্তু আসলে আগের মতো ফোর্স নিয়ে কাজ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আজকের তথ্য অনুযায়ী যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রভাবটাই হবে ব্যাপক।
ইউক্রেন নিজেই তাদের ব্যাংকগুলোতে একটা ইস্যু করেছে যে, কেউ ব্যাংক থেকে এক লাখ ডলারের বেশি অর্থ ওঠাতে পারবে না। আমেরিকা অর্থনৈতিকভাবে এখন কোল্ডওয়ারের পরিস্থিতি অনুযায়ী ওই স্ট্রেন্থে নেই। আর চীন এটাকে ফাইট দিচ্ছে। ন্যাটোকে দুর্বল করা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা পাশ্চাত্য শক্তিকে দুর্বল করে ফেলার জন্য চীন এখানে একটা রোল প্রয়োগ করতে পারে। চীন যদি সেই সুযোগটা নেয়, তাহলে ইউরোপভিত্তিক অর্থনৈতিক যে নিয়ন্ত্রণ, সেটা এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে এশিয়াতে চলে আসতে পারে। এটা এশিয়ার জন্য পজিটিভ। রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার এই দ্বন্দ্ব যদি একটু দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ এশিয়ার দিকে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
১৯৪৭ সাল অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব একটা কাঠামোতে দাঁড়িয়েছে। পুরো পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, একটা কাঠামো দীর্ঘদিন এভাবে টিকে থাকে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে টেকনোলজির উন্নয়নের গতি খুব কম ছিল। এর পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত টেকনোলজি যে পরিমাণ গতিশীল হয়েছে, এতে বহু আগেই বিশ্বের কাঠামো পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল। সেই ১৯৪৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৭৫ বছর যাবৎ এই কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি। তবে এই কাঠামোর পরিবর্তনটা কিন্তু এখন ঐতিহাসিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যে হামলা বা দ্বন্দ্বের কারণে এশিয়া এবং রাশিয়া অঞ্চলের সাথে পাশ্চাত্যের যে কালচারাল মেলবন্ধন, সেটার ফল আসলে কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। এমতাবস্থায় ন্যাটো যদি কূটনৈতিক উপায়ে না গিয়ে বিশ্বযুদ্ধের দিকে যায়, তাহলে পুরো পৃথিবীর কাঠামো এলোমেলো হয়ে যাবে। কারণ, ৭৫ বছর ধরে একটা কাঠামোতে চলছে। তবে এই কাঠামো এবং পাশ্চাত্যের ওপর কেউ সন্তুষ্ট নয়।
এটা ঠিক যে, রাশিয়া তার সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা ঠিক রাখবে। এখানে কিন্তু ন্যাটো প্রবেশ করেছে। রাশিয়া তাদের বারবার বলেছে তাদের জায়গাতেই থাকুক, এদিকে না আসুক। কাজেই ইউক্রেন, পোল্যান্ড, ক্রিমিয়া ইত্যাদি অঞ্চলগুলো কিন্তু রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য খুবই সেনসিটিভ। এতে কখনও রাশিয়া ছাড় দেবে না। এখন এই হামলার যদি কূটনৈতিকভাবে পতন না ঘটে, তাহলে পুরো বিশ্বের কাঠামো পরিবর্তন হয়ে যাবে।
তবে এই হামলা হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে যাবে না। কারণ, সবাই এখন বুঝতে পারছে, ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। ফ্রান্সও যে খুব ভালো অবস্থায় আছে তা নয়। একমাত্র সবার ভরসা হচ্ছে আমেরিকা। তো আমেরিকার একার পক্ষে চীন, রাশিয়া এবং এশিয়ার দেশগুলোকে প্রতিহত করার অবস্থানে তারা নেই। বিশেষ করে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পর আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ও সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি সব মিলিয়ে ভয়ানক খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়