এবার আড়ম্বরের ঈদ নয়, মানুষের পাশে দাঁড়াই

Looks like you've blocked notifications!

যত বড় মহামারি বা মহামন্দাই আসুক না কেন, বাংলাদেশের একটা অংশের জীবনে উৎসব আসতেই হবে। এই বাস্তবতার বাইরে সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা ভেবে সরকার ছুটি বাড়ালেও ধীরে ধীরে কিছু কিছু করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু করতে শুরু করেছে। সবশেষ ঘোষণা এসেছে, ঈদের আগে সারা দেশের দোকান ও শপিং মল খোলা হবে। আর এতে করেই সামাজিক মাধ্যমে ঝড় বইতে শুরু হয়েছে। অন্যান্য বছরে সারা রাত মার্কেট খোলা থাকলেও এ বছর বিকেল ৪টার মধ্যে বন্ধ করতে বলা হয়েছে।

সরকার খুলে দিতে বলেছে, যার ইচ্ছে হয় যাবে, যার হয় না যাবে না, এটাই আসল কথা হলেও আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সরকারের ঘোষণায় স্পষ্ট বলা আছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট ও শপিং মল সীমিত আকারে খোলা হবে। তবে এই নির্দেশ কতটা সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালিত হবে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সব দোকান এটা মেনে চলতে পারবে কি না, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। আরেকটা হলো ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধান। রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব শহরেই মার্কেট, বাজার ও শপিং মলের সামনে-পেছনে প্রশস্ত জায়গা কম। ফলে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা কীভাবে হবে, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে দোকানদারদের। আবার দোকানদার বা মার্কেট কর্তৃপক্ষ মানতে চাইলেও কিছু ক্রেতা যে আচরণ করবেন, তা মোটেও সহায়ক থাকবে না।

সরকারকে, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না তার দিকে। কাজটি কঠিন। আবার যে উদ্দেশ্যে এসব খুলে দেওয়া, তার অন্যতম হলো দোকান কর্মচারীরা যেন বেতন ও ঈদ উৎসবের ভাতা পায়। নিশ্চিত করে বলা যায়, অনেক দোকান ও শপিং মল মালিকই বলবেন, তাদের ব্যবসা হয়নি ঠিকমতো, তারা সেটা দিতে পারবেন না। আবার অনেকে এটা দেওয়ার ভয়ে সরকারি আদেশ থাকলেও দোকানপাট বা মার্কেট খুলবেনই না।

শতাব্দীর এই ভয়ঙ্করতম সংকটের মধ্যে পহেলা বৈশাখ চলে গেছে, কোনো ব্যবসা হয়নি। রোজার অর্ধেক চলে গেছে, ব্যবসা হয়নি। মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের রোজগার কমেছে, সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছে। তাদের জীবনে এবার আর ঈদ নেই। জীবিকার অনিশ্চয়তায় জীবন যায়-যায়। তবুও অনেকেই ঈদের অপেক্ষায় আছে। এদের বড় অংশই সরকারি চাকুরে, যাদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো হয়েছে এবং হবে, নানা ধরনের প্রণোদনারও কমতি নেই রাষ্ট্র থেকে। আর আছে ধনী মানুষ, যারা প্রতি ঈদে এলাহি খরচ করেন দেশ-বিদেশে শপিং করে। এবার বিদেশে যেতে পারছেন না বিধায় দেশে যেটুকু পারেন খরচ করার সুযোগ এসেছে, যদি শপিং মল খোলে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভয়ঙ্কর মহামারির ক্ষত বুকে নিয়েও কি কিছু মানুষ ঈদে খরচের বন্যা বইয়ে দেবেন? জনগণের একটা বড় অংশ হয়তো ভাবতে শুরু করেছে, নতুন জামা নয়, মাস্ক পড়ে, স্যানিটাইজার হাতে মেখে বা সাবান দিয়ে কবজি পর্যন্ত ধুয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে ঈদের দিন বের হবেন তাঁরা।

পহেলা বৈশাখে ব্যবসা হয়নি। বাংলা নববর্ষের বাজার পণ্ড হয়েছে। ঈদের বাজারও জমবে বলে মনে হয় না। বড় ব্যবসায়ীরা টিকে গেলেও হাজারও ছোট ব্যবসায়ীর জীবনে এরই মধ্যে নাভিশ্বাস উঠেছে।

বেসরকারি চাকরিজীবীদের অবস্থা বেশ সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। লাখ লাখ বেসরকারি চাকুরে ভাবছে ঈদের বোনাস দূরের কথা, কোনোরকমে বেতনটা পাবে তো? এই মানুষগুলো বাইরে এসে হাত পাততেও পারে না, বিক্ষোভও করবে না কখনো। এরা কোন দিকে যাবে তাহলে? তাদেরও পেট আছে, তাদেরও অন্য অনেক খরচ আছে। সরকারি প্যাকেজ, নগদ টাকা এই বিপর্যয় কতটা রুখতে পারবে, সে এক বড় প্রশ্ন। তাই সরকারের প্রচেষ্টা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঠিক রাখার পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচল হোক।

এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে যাঁরা মহাসমারোহে ঈদ করবেন বলে ভাবছেন, তাঁরা একটু ভিন্ন চিন্তা করতে পারেন এবার। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তাঁরা কী করবেন—মানুষের পাশে থেকে মানুষের দুঃখে শামিল হবেন, না কি গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে বিপুল উৎসাহে ঈদ করবেন?

এ বছরটা আসলে কোনোভাবেই উৎসবের নয়। সারা পৃথিবীতে মানুষের জীবন থেকে যাবতীয় বাহুল্য খসে পড়েছে। জার্মানি বলছে, করোনার অভিঘাতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে তাদের আট বছর লাগবে। রাশিয়ানরা বুঝতে পারছে অর্থনীতি আর আগের জায়গায় ফিরবে না, তাই তারা তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনছে, খরচ কমাচ্ছে। ফরাসি সরকার বলছে সহসা জীবন আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না।

এ যদি অবস্থা হয় ধনী দেশের, তাহলে আমরা কোথায় আছি? আমাদের খারাপ অবস্থা হয়েছে এবং আরো হবে, সন্দেহ নেই। তাই যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা ফি বছরের মতো আড়ম্বর, বিশাল আয়োজনের পেছনে না ছুটে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। এটাই এই মুহূর্তের একমাত্র দাবি। সামনের দিনগুলো আরো ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। তাই ঈদের যাবতীয় বাহুল্য বর্জন করতেই হবে। জীবনে অনেক তো আড়ম্বর হয়েছে, এবার সেভাবে না হলে ক্ষতি কী?

লেখক : সাংবাদিক