করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ

Looks like you've blocked notifications!

কোভিড-১৯-এর সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় তরঙ্গ নিয়ে অনেকে নানা ধরনের কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে তরঙ্গ বোঝা যায়নি, কারণ এখানে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও জন-অসচেতনতার কারণে করোনা পরিস্থিতির সঠিক তথ্য ও অবস্থা বোঝা যায়নি কখনোই। আবার অনেকেই বলছিলেন, সেপ্টেম্বরে হতে পারে সেই আশঙ্কার সেকেন্ড ওয়েভ। সেপ্টেম্বরও যায় যায়। ঠিক এ সময় সবাইকে সচেতন হতে পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে শীতকালে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। গত রোববার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেছেন, ‘শীতকাল আসন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে। আমাদের এ মুহূর্ত থেকেই তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে তাঁর সরকার যে করোনা পরিস্থিতিকে হালকাভাবে নেয়নি, সেটি বুঝিয়েছেন এবং একই সঙ্গে জনগণকে সচেতন হতে পরামর্শ দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, কেন এই আশঙ্কা? একটা কথা আমরা জানি, চীনে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছিল গত বছর শীতকালে তথা ডিসেম্বরে। এবং আমরা এও দেখেছি,  শীতপ্রধান দেশগুলোয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল করোনা। ফলে সারা বিশ্বেই আশঙ্কা করা হচ্ছে, শীতকালে এই রোগটির প্রাদুর্ভাব আবার বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশেও আমরা দেখি, শীতকালে ঠাণ্ডা ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, আসছে শীতে করোনাভাইরাস মহামারি আরো মারাত্মক রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে শীতের আগে থেকেই উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে।

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্তের পর সপ্তম মাস শেষ হতে চলেছে। এখন অনেক কিছুই স্বাভাবিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছু আগের মতো খুলেছে। অফিসে, আদালতে, রাস্তায়, বাজারে, উপাসনালয়ে জনসমাগম, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম দেখলে যে কেউ বলবে দেশটি থেকে করোনাভাইরাস চলে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যায়নি।

সংকট আছে, সংকট থেকে বাঁচার উপায় কী, সে নিয়ে নানা অভিমতও আছে। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হলো, সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অসচেতনতাও যেন অনেক বেড়েছে। আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুর হার কম। কিন্তু সেটিও ৩০ থেকে ৫০-এর ঘরে ঘোরাফেরা করছে প্রতিদিন, যেটা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। আমরা বলছি, আরো অবনতি হওয়ার আগেই সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিশেষজ্ঞরা উপদেশ দিচ্ছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সন্দেহ হলেও অনেক সময় সাধারণ মানুষ হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন না। এ ছাড়া রয়েছেন উপসর্গহীন আক্রান্ত। কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকায় তাঁরা দ্বিধাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে আরো বেশি। এ সমস্যা প্রতিরোধ করতে এবং কোভিডের দ্রুত বিস্তার ঠেকাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে অ্যান্টিজেন, অ্যান্টিবডির টেস্ট করানো আবশ্যক, এমনটাই বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এগুলো সবই পরামর্শ। সরকার কতটা শুনবে, কতটা রাখবে, কতটা সে পথে হাঁটবে, সেটি আমরা জানি না।

কিন্তু মানুষ নিজে নিশ্চয়ই আত্মঘাতী হতে পারে না অসংলগ্ন আচরণ করে। আমরা যেভাবে টিকা টিকা করছি, সেটিও কিন্তু অনেক দূরের ব্যাপার। অদ্যাবধি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। চিকিৎসকেরা নিজেরাও অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত। এর অর্থ হলো, পুরো পরিস্থিতিই তমসাচ্ছন্ন। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সচেতনতাই পারে মানুষকে বাঁচাতে। কেউ হাঁচি দিল বা কাশি দিল বা খুব নিকটে এসে কথা বলল; সেই লোকের ড্রপলেটের মাধ্যমে কোভিডে সংক্রমিত হয়ে মারা যেতে পারেন কাছাকাছি স্থানে থাকা মানুষ। এটুকু আমরা সবাই মোটামুটি জেনেছি। জেনেও আশ্চর্য রকম নিশ্চল; নৈর্ব্যক্তিক, উদাসীন থাকছি আমরা। করোনা মহামারির বিপদে মস্তিষ্কের যতটা সক্রিয়তা জরুরি, তার সিকিভাগও মিলছে না যেন।

হাটবাজারে, আদালতপাড়ায় জানা যায়, আড্ডায় মানুষ মাস্ক পরছে না। কিছু অসচেতন মানুষের এই ডোন্ট-কেয়ার ভাব সচেতন মানুষকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। অনির্দিষ্টকাল ট্রেন, বাস বা লঞ্চ না চললে বহু মানুষ রুজি-রোজগার হারিয়ে না খেতে পেয়ে মারা পড়বে। তাই সরকার বাধ্য হয়েছে সব খুলে দিতে। শারীরিক দূরত্ববিধি, সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলা হলেও এগুলো কোথাও এখন চেখে পড়ছে না। এ নিয়ে সরকারি নজরদারি নেই, এ কথা বলে বিস্তর সমালোচনাও করা যাবে। কিন্তু আমরা যদি শুধু মাস্ক পরি, ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখি, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করার ব্যাপারে সচেতন থাকি, তবেই  করোনাকে অনেকখানি পরাভূত করা সম্ভব।

শীত আসছে। প্রবল ঠাণ্ডায় জানালা-দরজা খোলা রাখাও সম্ভব নয়। শীতে ব্যবহৃত কাপড় প্রতিদিন পরিষ্কার করাও ঝামেলার। ঠাণ্ডায় পানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়াও কষ্টকর হবে। তাই এ সময়টায় নাক-মুখ ঢাকা মাস্কই হতে পারে একমাত্র করোনার মোক্ষম প্রতিষেধক। গবেষণা বলছে, প্রত্যেকে মাস্ক পরিধান করলে ৬৫ শতাংশ অবধি শারীরিক দূরত্বের কড়া বিধিনিষেধকেও শিথিল করা সম্ভব। মনে রাখা দরকার, উপসর্গহীন মানুষ যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়ে রোগ ছড়াচ্ছে আমাদের মাঝেই।

লেখক : সাংবাদিক