করোনা আতঙ্ক : কতটা সতর্ক হয়েছি আমরা?

Looks like you've blocked notifications!

চীন থেকে প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে। করোনাভাইরাসে হচ্ছে এসব মৃত্যু। এই নভেল করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা আড়াই হাজার ছুঁই ছুঁই। ঝুঁকিতে থাকলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। তবে দেশের বাইরে আবুধাবি ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশিদের আক্রান্তের খবর আসছে।

করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। কোনো ওষুধ এখনো এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। যদি ভাইরাসটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে বিশ্বের কাছে নিজেকে রক্ষার অল্প কয়েকটি মাত্র উপায় রয়েছে এবং এসব উপায় যদি কাজ না করে, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে, করোনাভাইরাসের মহামারি গোটা বিশ্বকে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যেতে পারে। করোনা আতঙ্কে চীনে যাচ্ছে না মানুষ। বিমান চলাচল বন্ধ করেছে অনেক দেশ। ভাইরাসের ভয়ে মার খাচ্ছে পর্যটন ব্যবসা। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এবং লুফথানসা বিমান সংস্থা চীনে সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। ক্যাথে প্যাসিফিক ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তাদের বিমানে বালিশ, কম্বল ও ম্যাগাজিন বহন বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিমান সংস্থাগুলোও, বিশেষ করে চীনে যাতায়াতকারী বিমানগুলো ক্ষতির মুখে পড়েছে যাত্রী কমে যাওয়ায়। অতীতে সার্সের মতো মরণ ভাইরাসের প্রকোপে পর্যুদস্ত হয়েছিল পর্যটন। সার্সের কারণে শুধু পর্যটনশিল্পের ক্ষতি হয়েছিল এক হাজার কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন যে, এবার নোভেল করোনাভাইরাসটি বিশ্ব পর্যটনশিল্পে এর চেয়ে বেশি লোকসান ঘটাবে। বাংলাদেশও নিশ্চয়ই এর বাইরে নয়।

অন্য কী কী ক্ষতি হবে, সেটা অনুমান করা যাচ্ছে না এখনই। তবে চীন যেহেতু সারা বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র, চীনের কাঁচামাল ও তৈরি পণ্যের ওপর বিশ্ববাজার নির্ভরশীল, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সারা বিশ্বে কাজ করে, ফলে বিশ্বব্যাপী একটা বড় বাণিজ্যিক ধাক্কা টের পাওয়া যাবে অচিরেই। এর মধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথানাশক ওষুধের অপরিহার্য উপাদান অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টসের (যেমন—প্যারাসিটামল, নিমুসিল্যাইড, অ্যাজিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি) দাম তিন-চার গুণ বেড়ে গেছে। খুব সহসা চীনের উৎপাদন স্বাভাবিক না হলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। মোবাইল ও কনজিউমার ইলেকট্রনিকস ক্ষেত্র, নির্মাণ শিল্প, নিত্যপণ্য কিছুই বাদ যাবে না। বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণে টেলিভিশন প্যানেল, এলইডি চিপ, ফ্রিজ-এসি এবং মোটরের কম্প্রেশার আমদানি হয় চীন থেকে। জোগান এখনই বন্ধ হবে কি না বলা না গেলেও একটা সংকটের সংকেত দিচ্ছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এটি মহামারি আকার ধারণ করার পর শুধু চীন নয়, পুরো বিশ্বই এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। চীন করোনা মহামারিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে টাস্কফোর্স তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটুকু সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) অবশ্য বলেছে, তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামালসহ অন্য পণ্য আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে বড় কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। কারণ ভাইরাসের সংক্রমণে সময়ে চীনে নববর্ষের ছুটি চলছিল। প্রতিবছর এই ছুটির অনেক আগেই বাংলাদেশের শিল্প উদ্যোক্তারা চীন থেকে তাদের শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করে ফেলেন। এবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ফলে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের বাজারে এখন পর্যন্ত কোনো পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়ার কারণ নেই।

তবে এ কথাও ঠিক যে, চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বৈশ্বিক জিডিপিতে চীনের অবদান ১৬ শতাংশ। চীনের অর্থনীতির ওপর যেকোনো আঘাত বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবেই। আমাদের বেশি ভাবনা রোগটি যেন বাংলাদেশে কোনোভাবে ঢুকতে না পারে। ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরান মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে বহু বাংলাদেশ নাগরিকের বাস। সরকারি উদ্যোগে যাঁদের আনা হয়েছে, তাঁরা ছাড়া বাকি বাংলাদেশিরা আসতে পারছেন না আপাতত। দেশটির ১৩টি প্রদেশে ও তাইওয়ানে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। আবার চীনের এখন অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশের সঙ্গে। শত শত চীনা নাগরিক একটা সময় আসা-যাওয়া করেছে।

শুধু চীন নয়, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, আবুধাবিতেও থাকে অসংখ্য বাংলাদেশি। বিমানবন্দরগুলোয় কতটা ভালো করে যাত্রীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে, সে এক বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশ কোনোভাবেই নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে না। বিমানবন্দরে চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা অন্য দেশ থেকে আসা মানুষের ঠিকমতো পরীক্ষা হচ্ছে না বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে রাতে যাঁরা নামছেন, তাঁদের থার্মাল চেক ছাড়াই বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসছেন বলে অনেকে সামাজিক মাধ্যমে জানাচ্ছেন।

হঠাৎ আমদানি হওয়া এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো কাজ নয়, কিন্তু যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করে এগোতে হবে সরকারকে, চিকিৎসকদের। মোদ্দাকথা হলো, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ যতটা সতর্ক রয়েছে, তা থেকেও অধিক সতর্কতা প্রয়োজন।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা