করোনা ও হৃদরোগ : যা জানা জরুরি

Looks like you've blocked notifications!

করোনাভাইরাস, যার পোশাকি নাম কোভিড-১৯, রোগটি বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। তাই বাড়ছে আতঙ্ক। সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া—সবখানেই এখন একটাই বিষয়, করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাস অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাস, যা প্রথমবারের মতো মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে। যদিও যেকোনো বয়সেই এ ভাইরাসের শিকার যে কেউ হতে পারে। তবুও যাদের হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টের রোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ ইত্যাদির মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে একটু বেশি ভীতির সঞ্চার করেছে। এর কারণ, করোনাভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগে যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের অনেকেই আক্রান্ত ছিলেন হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, সিওপিডি, ডায়াবেটিস ইত্যাদির মতো ক্রনিক রোগে। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ রোগে প্রথম মৃত্যুবরণকারী রোগীটিও ছিলেন হৃদরোগী, যাঁর হার্টের করোনারি ধমনিতে রিং পরানো ছিল। অর্থাৎ হার্টের রক্তনালি ব্লকজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। আরো অন্য রোগও ছিল।

 

হৃদরোগীদের কি করোনাভাইরাস বেশি আক্রান্ত করে?

এ কথা সরাসরি বলা যাবে না। আবার পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, হ্যাঁ, হৃদরোগীদের করোনাভাইরাস বেশি ক্ষতি করেছে। চীনে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছিল, তাদের মধ্যে হৃদরোগীর সংখ্যা অনেক। এটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মৃত্যু হয়েছিল করোনাভাইরাস সংক্রমণে, তাদের অনেকের হৃদরোগ ছিল। আর তাই হৃদরোগীদের মধ্যে আতঙ্ক বেশি কাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, হৃদরোগীদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে, তাই সহজেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে জটিলতা বাড়ে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণে কি হার্ট অ্যাটাক হতে পারে?

যদিও করোনাভাইরাস মূলত ফুসফুসে বেশি ক্ষতি করে এবং এ কারণে কোভিড-১৯ রোগীদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কিন্তু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ ভাইরাস হার্টের মাংসপেশিতেও ক্ষতি করতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যেসব কোভিড-১৯ রোগী ভেন্টিলেটর সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের প্রতি পাঁচজনের একজনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল এবং ফুসফুসের শ্বাসকষ্ট ছাড়াই মৃত্যু হয়েছিল। হার্ট করোনারি ধমনির মাধ্যমে পুষ্টি পায়। এই করোনারি ধমনিতে মারাত্মক ধরনের চর্বি দিয়ে যদি আংশিক ব্লক থাকে, করোনার প্রভাবে তা শতকরা একশ ভাগ ব্লক হয়ে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এমনকি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এসব রোগীর শ্বাসকষ্টের সঙ্গে বুকে ব্যথাও হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে রোগী যদি দীর্ঘমেয়াদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগী হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে বুকে ব্যথা না-ও থাকতে পারে। ইসিজি ও রক্তের ট্রপোনিন আই নামক বায়ো মার্কার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

মায়োকার্ডাইটিস

মায়োকার্ডাইটিস হলো হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির প্রদাহ। করোনাভাইরাসের কারণে হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশিতে আঘাতের কারণে মায়োকার্ডাইটিস হতে পারে। মায়োকার্ডাইটিস হার্টের এমন একটি অবস্থা, যা থেকে রোগী এমনি এমনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেতে পারে। আবার মারাত্মক জটিলতা হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। হার্টের ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষা করে এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মায়োকার্ডাইটিস শনাক্ত করা যেতে পারে।

হার্ট ফেইলিউর হয়েও শ্বাসকষ্ট হতে পারে

হার্ট ফেইলিউর হলো হার্টের এমন একটি অবস্থা, যা দুই ধরনের হতে পারে। একটি হলো ক্রনিক হার্ট ফেইলিউর, যা আগে থেকেই রোগীর ছিল। এ ধরনের রোগীর হার্টের কার্যক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে। অনেক রোগী বলে থাকেন হার্ট দুর্বল। হার্টের ইকোকার্ডিওগ্রাফি, বুকের ইসিজি ও এক্সরে করেও জানা যেতে পারে। এ ধরনের রোগীদের হার্ট আকারে বড় হয়ে সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা কমে যায়। আর অ্যাকিউট হার্ট ফেইলিউর হঠাৎ করেই হতে পারে। হার্টের সংকোচন-প্রসারণ কার্যক্ষমতা লোপ পেয়ে রোগীর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। গবেষকদের মতে, করোনাভাইরাসের কারণে অ্যাকিউট হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। অথবা ক্রনিক হার্ট ফেইলিউরের রোগীদের হঠাৎ করেই হার্টের মুমূর্ষু অবস্থা, অ্যাকিউট হার্ট ফেইলিউর হতে পারে।

করোনার প্রভাবে হার্টে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন হতে পারে

করোনাভাইরাসের ক্ষতির কারণে হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন ব্যাহত হতে পারে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে ট্যাকিকার্ডিয়া হতে পারে। ড্রপ বিটসহ নানা ধরনের নানা নামের অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন হতে পারে। এ অবস্থাও এমনি এমনি ভালো হয়ে যেতে পারে, আবার বড় ধরনের সমস্যাও করতে পারে। তবে যেসব রোগী করোনাভাইরাসের প্রভাবমুক্ত হয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তাঁদেরও পরবর্তী সময়ে কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

করোনায় হার্ট অ্যাটাক হলে করণীয়

পৃথিবীর সব দেশে প্রতিটি রোগব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায়। আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি এবং অন্যান্য হৃদরোগবিষয়ক সোসাইটি অ্যাকিউট হার্ট অ্যাটাক হলে শুধু উপসর্গমাফিক চিকিৎসা বা ওষুধের দ্বারা চিকিৎসাকে সমর্থন করেছেন। সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের রোগী যদি হার্ট অ্যাটাকের পর দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে, তাহলে সরাসরি ক্যাথল্যাবে করোনারি এনজিওগ্রাম করে করোনারি এনজিওপ্লাস্টি করা হয়। এই চিকিৎসাকে বলা হয় প্রাইমারি পিসিআই। অর্থাৎ রক্তনালি ব্লক হলে হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে সঙ্গে স্টেন্ট বা রিং পরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে রক্তনালিতে আবার রক্তপ্রবাহ হয়ে হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এই চিকিৎসাকে সারা বিশ্বে হার্ট অ্যাটাকের আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু কোভিড-১৯ রোগের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক হলে রক্ত পাতলা করার বিশেষ ওষুধ দ্বারা এই চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এ ছাড়া বর্তমান মহামারিতে হার্টের নিয়মিত আধুনিক চিকিৎসা করোনারি স্টেনটিং (Coronary stenting) ও বাইপাস সার্জারিও করা হচ্ছে না। সব ধরনের রুটিন চিকিৎসাকে পিছিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে চিকিৎসাকালীন চিকিৎসকদের মধ্যেও কোভিড-১৯ রোগ সংক্রমিত হতে পারে। তাই চিকিৎসকদের বলা হয় সুপার স্পেডার। এবং চিকিৎসকের মাধ্যমেও অন্য রোগীদের মধ্যে ছড়াতে পারে করোনাভাইরাস। তাই রক্ত পাতলা করার ওষুধ ও ইনজেকশনের মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে।

অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ প্লাজমা যখন কোভিড-১৯ চিকিৎসায়

যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে কয়েকজন মুমূর্ষু কোভিড-১৯ রোগী (যারা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসায় আছেন), এমন রোগীর রক্তে অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ প্লাজমা দিয়ে চিকিৎসায় সাফল্য পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে চীনেও একটি গবেষণায় এ ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ কোভিড-১৯ রোগী যারা ইতোপূর্বে সুস্থ হয়েছেন, তাদের রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ প্লাজমা সংগ্রহ করে নতুন মুমূর্ষু কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে।

ধূমপান ও করোনাভাইরাস

ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক করোনাভাইরাসের জন্য অবশ্যই একটি ঝুঁকি। করোনাভাইরাসের প্রথম লক্ষ্য ফুসফুসের অ্যালভিওলাকে ক্ষতি করা। এ ছাড়া ধূমপানে এমনিতে ফুসফুসের প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষতি করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল করে দেয়।

চীনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ধূমপায়ীদের ঝুঁকি পাওয়া গেছে এবং পুরুষের মধ্যে এ ধূমপানের ক্ষতি বেশি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া যারা অ্যাকিউট ডিসট্রেস সিনড্রোম নামক জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ধূমপানের ইতিহাস ছিল। এ ছাড়া ভাইরাস সংক্রমণে ধূমপান একটি কারণ হতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও করোনাভাইরাস

যারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন, তাঁদের ঝুঁকি আছে করোনাভাইরাসে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। সেক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বেশি। চীনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যুবরণকারী অনেকেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। তাই যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে অথবা পরিবারে এ ধরনের রোগের ইতিহাস আছে, তাঁদের সচেতন থাকতে হবে। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে হবে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।

স্টেনটিং ও বাইপাস সার্জারি রোগী

বাংলাদেশে যেসব রোগী এর আগে হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনিতে ব্লকজনিত কারণে স্টেনটিং বা রিং পরিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ঝুঁকিজনিত আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া যারা এর আগে বাইপাস সার্জারি করেছেন, তাঁদের মধ্যে ঝুঁকি আছে।

লেখক : অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়