কিশোরদের কতটা উন্নয়ন হচ্ছে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে?
আইনশাস্ত্র অনুযায়ী, শাস্তির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো অপরাধীকে সংশোধন করা। বয়সে তরুণদের ক্ষেত্রে এটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। তেমনই ইতিবাচক উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু হয় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের। ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিরা শিশু হিসেবে কারাগারের পরিবর্তে উন্নয়ন কেন্দ্রে যায়। বাংলাদেশে এ ধরনের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে তিনটি, যার মধ্যে দুটি বালক ও একটি বালিকাদের জন্য। বালকদের জন্য গাজীপুর ও যশোরে এবং বালিকাদের জন্য গাজীপুরে রয়েছে একটি উন্নয়ন কেন্দ্র।
এই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত বা সংস্পর্শে আসা শিশু বা অভিভাবক কর্তৃক প্রেরিত শিশুদের উন্নয়ন ও স্বাভাবিক জীবনে একীভূত করার লক্ষ্যে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয় প্রেরিত শিশুদের কেস ওয়ার্ক, গাইডেন্স, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিকতার উন্নয়ন, ডাইভারশন ইত্যাদি স্বীকৃত পদ্ধতিতে রক্ষণাবেক্ষণ, ভরণপোষণ, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন করে কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল নাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এসব উন্নয়ন কেন্দ্র শিশু আইনের পাশাপাশি ১৯৬০ সালের প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর এসব কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনা করে।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের এসব উদ্দেশ্য কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব কিশোর কেন্দ্রের মান নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ। কিশোরদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন করে কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল নাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসনের যে উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, তার বালাই নেই সেখানে। বরং এসব উন্নয়ন কেন্দ্রে অপরাধী কিশোরদের সংস্পর্শে এসে তুলনামূলক লঘু অপরাধ করে আসা কিশোরদেরও ভয়ংকর অপরাধী হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
এসব কেন্দ্রের মান উন্নয়নের দাবিতে ২০১৪ সালে শরীর রক্তাক্ত করে প্রতিবাদ করেছিল বন্দি কিশোররা। টঙ্গী ও গাজীপুর দুই জায়গাতেই টিউবলাইট ভেঙে ও ব্লেড জাতীয় জিনিস দিয়ে তারা নিজেদের শরীর থেকে রক্তপাত ঘটিয়ে প্রতিবাদ জানায়। তখন তারা সেখানে নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও আনে। কোনো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিং তো অনেক দূরের কথা।
ওই ঘটনার পর টঙ্গী কেন্দ্রের পাশ দিয়ে গেলে কিশোররা চিরকুট ছুড়ে দিত। যাতে লেখা থাকত কর্মকর্তাদের নির্যাতন, নিম্নমানের খাবার প্রদান ও দুর্ব্যবহারের কথা।
এর পাশাপাশি স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল, কিছু খারাপ প্রকৃতির কিশোরও সেখানে রয়েছে। যারা ভেতর থেকে বাইরের মানুষকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করত। বাউন্ডারির পাশের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময় স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের ইভটিজিং থেকে শুরু করে পলিথিনে মলমূত্র ভরে পথচারীদের গায়ে ছুড়ে মারার মতো অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। সেখানে মাদকও সরবরাহ করা হতো নানা কৌশলে।
দুটি কেন্দ্রে রক্তাক্ত প্রতিবাদের ঘটনার পর মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. আইয়ুব হোসেনের নেতৃত্বে অনিয়ম তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান তখন কোনো অনিয়ম থাকলে তা দূরীকরণের ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই ঘটেনি।
এবার যশোরের উন্নয়ন কেন্দ্রে যা ঘটেছে, তা আর অনিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সর্বোচ্চ রকমের অপরাধে রূপান্তর হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই কেন্দ্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কিশোরদের একটি অংশকে নিয়ে আরেকটি অংশের ওপর শুধু নির্যাতনই করেনি, তিনজন কিশোরকে হত্যা করেছে। এমনকি মারপিটে নিহত ও আহত কিশোরদের ছয়-সাত ঘণ্টা ফেলে রেখে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই নির্যাতনে তিন কিশোর নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ওই কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক প্রবেশন অফিসার মাসুম বিল্লাহ, কারিগরি প্রশিক্ষক ওমর ফারুক, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর এ কে এম শাহানুর আলম ও সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলর মুশফিকুর রহমানকে। সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড সত্যিই নিন্দনীয়।
বরং অবস্থা যা, তাতে এসব কেন্দ্রকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র না বলে কিশোরদের জেলখানা বলাই শ্রেয় হবে। যদি কিশোরদের এসব উন্নয়ন কেন্দ্রে রেখে উদ্দেশ্যই সফল না হয়, তবে তাদের কারাগারে রাখলেই বা কী সমস্যা? কারণ ভালো উদ্দেশ্যে নেওয়া একটি পদক্ষেপে এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ আকার ধারণ করেছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। শুধু ব্যক্তির বদলেই পরিস্থিতি বদলাবে না। যেসব কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ঘটনায় হওয়া তদন্ত কমিটি এবং আগের তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে। প্রয়োজনে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কিশোরদের জন্য আলাদা সেল করতে হবে। না হয় লঘু অপরাধে উন্নয়ন কেন্দ্রে যাওয়া কিশোররা বের হবে বড় অপরাধী হয়ে।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর সার্বিক মান পর্যবেক্ষণে একটি স্থায়ী মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। এ ছাড়া কিশোরদের নিয়মিত কাউন্সেলিং, শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বের হয়ে তারা অপরাধজগৎ ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারে।
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা জজকোর্ট