পদ্মা সেতু
কৃষিনির্ভর যশোরে নতুন দিগন্তের উন্মোচন
কৃষি হলো যশোর অঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণ। প্রধান সব কৃষি পণ্যই এখানে উদ্বৃত্ত উৎপাদিত হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে যা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। শীত-গ্রীষ্ম মিলিয়ে এ জেলায় বছরে ৬ লাখ টনেরও বেশি সবজি উৎপাদিত হয়। পটল, বাঁধাকপিসহ সাত-আট ধরনের সবজি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে।
সারা দেশে রেনু পোনার মোট চাহিদার অর্ধেকই যশোরের হ্যাচারিগুলোতে উৎপাদিত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়েও এ রেনু পোনার একটি বড় অংশ দেশের অন্য অঞ্চলে পাঠানো হয়। দেশে কাঁচা ফুলের যে চাহিদা রয়েছে, তারও বেশির ভাগটাই সরবরাহ করা হয় যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে। দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দরও এ জেলাতেই। রয়েছে নওয়াপাড়া নৌবন্দর। এ দুটি স্থল ও নৌ বন্দর এবং যশোর শহরের সাথে দেশের প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগ চালু রয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালু চলেই যশোর অঞ্চলের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে বড় দিগন্তের উন্মোচন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যশোরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, বছরে এ জেলায় সাড়ে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে ৬ লাখ টনের বেশি অন্তত ২২ ধরনের সবজি উৎপাদন করেন চাষিরা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই সবজির বড় একটি অংশ রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। গত কয়েক বছর ধরে এখান থেকে স্বল্প মাত্রায় সবজি রপ্তানিও হচ্ছে। যাচ্ছে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ফেরি পারাপারে দেরি হওয়ায় প্রতিবছর প্রচুর সবজি রাস্তাতেই নষ্ট হয়ে যায়। এতে সবজি চাষি ও ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে অনেক কম সময়ে ব্যবসায়ীরা সবজি নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে পারবেন। এতে সময় কম লাগায় সবজি একদিকে যেমন নষ্ট হবে না, টাটকা থাকায় দামও পাওয়া যাবে ভালো।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, দেশে মোট যে পরিমাণ কাঁচা ফুল উৎপাদিত হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি যশোরের গদখালীর চাষিরা উৎপাদন করে থাকে। এসব ফুল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব জেলা তো বটেই, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বেশির ভাগ জেলাতেই পাঠানো হয়। তিনি বলেন, সবজির মতো ফুলও দ্রুত পচনশীল একটি পণ্য। তাছাড়া ফুলের মতো একটি পণ্য পরিবহণের জন্য আমাদের দেশে এখনও স্পেশালাইজড কোনও ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ট্রাক কিংবা যাত্রীবাহী বাসের ছাদে করে এসব ফুল বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। এতে অনেক ফুল নষ্ট হয়। ফেরিঘাটে দেরি হওয়ার কারণেও ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। আব্দুর রহিম বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা এ ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাবেন। ফুল পরিবহণে সময় কমে গেলে ফুল রপ্তানিও বাড়বে।
যশোর জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান বলেন, দেশের অর্ধেক রেনু পোনা যশোরের হ্যাচারিগুলো সরবরাহ করে থাকে। দেশের প্রায় সব জেলা মৎস্যচাষিরা যশোর থেকে রেনু পোনা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। রেনু পোনা খুবই সেনসেটিভ। নানা কারণে ফেরিঘাটে বিলম্বের কারণে ৩০ শতাংশ রেনু পোনা মারা যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে অনেক কম সময়ে তারা রেনু পোনা বিভিন্ন জেলায় পাঠাতে পারবেন। এতে রেনু পোনার বড় একটি অংশ তারা বাঁচাতে পারবেন, লাভের পরিমাণ বাড়বে, হ্যাচারি মালিকরাও রেনু পোনা উৎপাদনের পরিধি আরও বাড়াতে উৎসাহিত হবেন।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে নিঃসন্দেহে যশোরসহ পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের গতি সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, স্থলবন্দরগুলো দিয়ে দেশে যত পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়, তার বড় একটি অংশই যশোরের বেনাপোল বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। দেশের বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামালও আসে এ পথেই। এ সব কাঁচামাল দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ফেরি পার হয়ে দেশের অন্য স্থানগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়।
পদ্মা সেতু চালুর পর যশোর খুলনা অঞ্চলে শিল্প-কলকারখানা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হবেন শিল্পমালিকেরা। বেনাপোল দিয়ে কাঁচামাল এনে কম সময়ে এসব শিল্প-কলকারখানায় পৌঁছানো যাবে। উৎপাদিত পণ্য পদ্মা সেতু দিয়ে খুব সহজেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে। মিজানুর রহমান খান বলেন, যশোরের নওয়াপাড়া নৌবন্দর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম একটি বড় মোকাম। বেনাপোল বন্দর দিয়ে ট্রেনে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য এই নওয়াপাড়াতেই নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সড়ক ও নৌপথে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। এ ছাড়া নৌপথে আমদানি করা সার নওয়াপাড়া বন্দরেই নিয়ে আসা হয়। এরপর সড়ক ও রেলপথে তা বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। ফলে পদ্মা সেতু চালুর পর বেনাপোল স্থলবন্দর ও নওয়াপাড়া নৌবন্দর কেন্দ্রক ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসার ঘটবে বলে তিনি মনে করেন। তবে তিনি বলেন, যশোর ও নওয়াপাড়া নৌবন্দরের মাঝামাঝি এলাকাতে যদি সরকার একটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করে, তবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের গতি আসবে। তিনি বলেন, সদর উপজেলার বসুন্দিয়াতে রেলওয়ের বড় একটি জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। যশোরের ব্যবসায়ী সমাজ দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি করে আসছে ওই জায়গাতে একটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য।
লেখক : স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, যশোর