কেউ কেউ ঝটপট জনপ্রিয় হতে চায়, কেন?

Looks like you've blocked notifications!

ল্যাবএইডের চেম্বারে রোগী দেখছিলাম। রোগী দেখা শেষ হলে একজন সুঠামদেহী যুবক চেম্বারের ভেতরে এসে অত্যন্ত মার্জিতভাবে আমার সঙ্গে কিছু কথা শেয়ার করতে চাইলেন। তিনি প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ার গুণগান গাইলেন, তারপর সোশ্যাল মিডিয়াকে কীভাবে স্মার্টলি ব্যবহার করে নিজের নাম-যশ-খ্যাতি ইত্যাদি অর্জন করতে পারেন, তার বয়ান দিলেন। দেশ-বিদেশের কিছু উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশেরই একজন সফল চিকিৎসকের উদাহরণ দিলেন, যিনি ফেসবুকের মাধ্যমে নিজের পরিচিতি কাজে লাগিয়ে বর্তমানে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন এবং যা তাঁকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করেছে...  ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম, বেশ ভালো আইডিয়া। কে না চায় জনপ্রিয় হতে! কিন্তু আপনারা কী করবেন বা আপনার লাভই বা কী।

তিনি জানালেন, তাঁদের এই বিষয়ে করপোরেট অফিস আছে এবং অনেকটা সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় পপুলার ফিগারে পরিণত করবেন। ফেসবুকের স্ট্যাটাসগুলোকে হাজার হাজার লাইক-শেয়ার করিয়ে অল্পদিনের মধ্যে সামাজিকভাবে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। আমি জিজ্ঞেস করি, এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি বেশ জোর দিয়েই বললেন, এটি সম্ভব। আপনাকে সিস্টেমে আসতে হবে। বিনিময়ে মাসে ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে। কারণ, তাঁরা আপনাকে দিয়ে কিছু ভিডিও বানাবেন। তারপর সবকিছু তাঁদের কাজ। আপনি দেখবেন, আপনার স্ট্যাটাসে হাজার হাজার লাইক-শেয়ার-কমেন্ট... ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা যে একটি পেশা হতে পারে, আমি কোনোদিন ভাবতেও পারিনি। এসব বছর দুয়েক আগের কথা। আমি অবাক হয়ে তাঁর প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করি।

কিছুদিন পর ওই ব্যক্তি আবার এলেন আমার চেম্বারে। সঙ্গে আরেকজন কলিগ। আবারও একই প্রস্তাব দিলেন। আবারও বিনয়ের সঙ্গে না বলে দিই। যাওয়ার সময় আমাকে প্রমাণ হিসেবে সেই চিকিৎসকের ফেসবুকের দুটি আইডির জনপ্রিয়তার পার্থক্য দেখালেন। একটি আইডির স্ট্যাটাসে হাজার হাজার লাইক-শেয়ার-কমেন্ট, অন্যটিতে খুবই সামান্য। আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম।

নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার বাসনা মানুষের আমৃত্যু সাধনা—এ কথাটি বলতেন অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। ১৯৮৮ সালে টিএসসিতে ‘কথা’র কর্মশালায় এ কথা বলেছিলেন তিনি। আমি কথাটি মনের গহিনে গেঁথে রেখেছিলাম। তখন তো ফেসবুক ছিল না। কিন্তু কে না প্রিয় হতে চায় অন্যের কাছে? দুনিয়া এক আজব রসায়নাগার। কিছু মানুষ নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখতে চায়, আবার কিছু মানুষ ঠিক তার উল্টো। সামাজিক মাধ্যমে কীভাবে আপনার ফলোয়ার বাড়াবেন, তার জন্যও নানা ধরনের টিপস পাবেন অনলাইন সার্চে।

কিছু মানুষ খবরে থাকতে পছন্দ করেন। করোনাভাইরাস নিয়ে একজন বাংলাদেশি ডাক্তারের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। পুরো বিশ্ব যখন এই ভাইরাসকে নিয়ে হতাশায় ভুগছে, তখন তিনি বলেন, যেসব দেশের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রির ওপর, সেখানে এ রোগ ছড়ায় না। এই বিভ্রান্তিকর অবৈজ্ঞানিক ভিডিওটি নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই সমালোচনা করেছেন।

শুধু তা-ই নয়, ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, মার্চ মাসটা যাক, দেখবেন এপ্রিল থেকে আর এই রোগ অতটা গুরুতর থাকবে না। আশার এই বাণী ও তথ্যগুলো চারপাশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি। পাঠক, ওই ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি নিয়ে আপনি এখন কী বলবেন? আরেকটি বিষয়, ঝটপট ভাইরাল হওয়ার জন্য টাইমিং একটা ফ্যাক্টর। অর্থাৎ সঠিক সময়ে স্ট্যাটাস দেওয়াও জনপ্রিয় হওয়ার একটি কৌশল।

মানুষ অজান্তেই তাদের ফলো করে, যারা তাদের পছন্দের বিষয় নিয়ে চর্চা করে। মানুষের মনের ভেতরের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলোকে কেউ যদি সহজে বাতলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, সবাই তাঁর প্রতি আকর্ষণবোধ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। যেমন ধরুন, মানুষের হাঁটুব্যথার চিকিৎসার একটি ওষুধ ভারতীয় টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখাত এবং বলা হতো, এত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে। যেহেতু বাতব্যথার ভালো কোনো কার্যকর স্থায়ী ওষুধ নেই, তাই চটকদার বিজ্ঞাপনে অনেকে আকৃষ্ট হয়ে ওষুধ কিনে পকেট খালি করেছেন। রোগ তো ভালো হয় না। কোনো এক বেরসিক লোক তার রোগ ভালো না হওয়ায় আদালতে যান এবং মামলায় জয়ী হয়ে তাঁর ক্ষতিপূরণ পান। এটি একটি ব্যতিক্রম ঘটনা।

ধরা যাক, আপনি ভুঁড়ি কমাতে চান। যেহেতু ভুঁড়ি কমানোর চিকিৎসা মেডিকেল সায়েন্সের ওষুধ দিয়ে তেমন ভালো করাতে পারছেন না, তাই নানা ধরনের বিকল্প চিকিৎসার কথা শোনা যায়। এখন কেউ যদি বিদেশি একটি সিরাপ খাইয়ে আপনার ভুঁড়ি কমানোর গ্যারান্টি দেয়, তখন স্বাভাবিকভাবে অনেকে সেই ভিডিওতে হাজার হাজার লাইক দেবেন। আর ওই সিরাপ কোম্পানি পয়সা খরচ করে ওই পোস্টটিকে বুস্ট করতে করতে আপনার লাখ লাখ ফলোয়ার্স তৈরি করে দেবেন। যদি ওই বিদেশি সিরাপ খেয়ে ভুঁড়ি কমানো যেত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে এত স্থূলকায় মানুষ থাকত না। মূল কারণ, বেশির ভাগ মানুষই ব্যায়াম করে কষ্ট করতে ইচ্ছুক নন। সবাই শর্টকাট পথে ভুঁড়ি কমাতে চান।

বাংলাদেশের এক বিখ্যাত চিকিৎসক করোনা বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কথা বলে যতটা লাইক পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি লাইক পেয়েছেন যিনি বলেছিলেন, এত তাপমাত্রায় করোনাভাইরাস বেঁচে থাকতে পারে না। তাই বাংলাদেশে করোনা আসবে না। এমন ভবিষ্যদ্বাণীও অনেকে করেছিলেন এবং ব্যাপক লাইক পেয়েছিলেন।

শুধু শর্করা খাবার পরিচয় করিয়ে দিতে একজনের একটি ভিডিও লাখ লাখ শেয়ার হয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক নাকি অবৈজ্ঞানিক কথা বেশি ভাইরাল হয়, এটি জানতে ইচ্ছে হয়। তবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী প্রত্যেকের প্রতি বিনীত অনুরোধ, যেভাবেই হোক গুজব এড়িয়ে চলবেন। কোনটি গুজব আর কোনটি সত্য যাচাই করে শেয়ার করবেন।

প্রতিভার প্রচারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া শক্তিশালী একটি মাধ্যম বটে। সংঘাতমুখর সভ্যতায় সামাজিক মাধ্যম নিছক তামাশার বা তৃপ্তিদায়ক-আনন্দদায়ক বিষয় নয়।

পরিশেষে বলতে চাই, অন্তর্জালের এই যুগে নিজেকে কতটুকু প্রকাশ করবেন, কেন করবেন ইত্যাদি বিষয়গুলোর পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। ভাইরাল হয়ে ফলোয়ার বাড়িয়ে যেমন আপনি ঝটপট আপনার তথাকথিত জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নিতে পারেন, তেমনি পড়তে পারেন নানা বিড়ম্বনায়। যা কিছুই করুন না কেন, বিবেকতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোবেন। স্ট্যাটাস দেওয়ার সময়, শেয়ার করার সময়ও বিচার-বিশ্লেষণ করে নেবেন। তথ্য কতটুকু সঠিক বা বিজ্ঞানভিত্তিক, তা যাচাই করা জরুরি।

লেখক : অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়