খেজুর গুড় ও গাছির পেশা রক্ষায় এসটিইয়ের ভূমিকা

Looks like you've blocked notifications!

“যশোরের যশ, খেজুর রস”। যশোর জেলার নাম শুনলেই মনে পড়ে খেজুর গুড়ের কথা। অথচ সময়ের বিবর্তনে সেই খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য আজ যাদুঘরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন মাঠের পর মাঠ খেজুর গাছের বাগান ছিল। যা যশোর অঞ্চলের তরুণ প্রজন্মের কাছে আজ লৌকিক সাহিত্যের মতো।

যশোর অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রস জ্বালানোর চুলা ছিল। শীতের মৌসুমে গ্রাম এলাকায় পিঠা-পুলির আমেজ চলতো। কাঁচি পোড়া পিঠা রসে ভিজিয়ে মেয়ে জামাই বাড়ি হাড়ি ভরে না পাঠালে শাশুড়ির আত্মতৃপ্তি হতো না। যশোর অঞ্চলে এখন আর নব-বধূদের মাটির ভাড়ে করে গুড় নিয়ে যেতে দেখা যায় না। দেখা যায় না কুয়াশার মধ্যে রস খাওয়ার লোভে গাছি (যারা খেজুর গাছ কেটে রস,গুড় তৈরি করে) দাদুদের পিছে পিছে গ্লাস নিয়ে বাচ্চাদের ঘুরতে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে এসব গ্রামীণ রীতি আজ শুধুই স্মৃতি।

যশোর অঞ্চলে যেমন কমেছে খেজুর গাছের সংখ্যা তেমনই কমেছে গাছির সংখ্যা। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেও এখন আর গাছি খঁজে পাওয়া যায় না। অত্যন্ত কষ্টের পেশা হওয়ায় গাছিরা এখন অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। আগের দিন বিকালে খেজুর গাছ কাটা, পরের দিন সকাল ভোরে গিয়ে প্রতিটা গাছ থেকে রসের ভাড় নামানো। রস বাড়িতে এনে ৫/৬ ঘন্টা ধরে জ্বাল দিয়ে রস তৈরী   করা। শীতে এতো হাড় কাঁপানো পরিশ্রম করেও গুড়-পাটালীর ন্যায্য মূল্য গাছিরা পাচ্ছে না।

অসাধু ব্যবসায়ীরা কম দামে ভেজাল গুড় সরবরাহ করে বাজার দখল করে রেখেছে। গাছি না পাওয়া ও আবাদী জমি স্বল্পতার কারণে মালিকরা খেজুর গাছ কেটে ফেলছে। এদিকে দরিদ্র শ্রেণির গাছিদের জন্য নেই কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রণোদনার ব্যবস্থা। অথচ একটু সুদৃষ্টি দিলেই যশোরের বিলুপ্তপ্রায় গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী জেলাব্রান্ড পণ্য খেজুর গুড় ও গাছি পেশা টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

এতো প্রতিকূলতার পরেও যশোরের গৌরবময় এই ঐতিহ্যটি টিকিয়ে রাখতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে সেভ দ্য ট্র্যাডিশন অ্যান্ড এনভায়ররনমেন্ট (এসটিই) নামের একটি অলাভজনক সংস্থা। সংস্থাটি খেজুর গাছ রোপণ, তরুণ প্রজন্মতে গাছি পেশায় অন্তর্ভুক্তিকরণ, গাছি সমাবেশ,  নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, চিনির বিকল্প হিসেবে খেজুর গুড়ের প্রমোশন বৈঠক এবং গাছি পেশা টিকিয়ে রাখতে ত্রাণ বিতরণ, গাছি সন্তানদের শিক্ষা সংক্রান্ত সহায়তা, শীতবস্ত বিতরণ, গুড় উৎপাদন উপকরণ প্রদান, উৎপাদন প্রশিক্ষণ প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, গুড়ের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণসহ  বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

খেজুর গাছ শুধু ঐতিহ্য রক্ষা করে তা নয়। বনায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, ভূমিক্ষয় রোধ, বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সা্ম্প্রতিক বছরগুলোতে যশোরের আবহাওয়া দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে।  গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত উঠে যায়, আবার শীতকালে শৈত্যপ্রবাহ পরিলক্ষিত  হচ্ছে। আবহাওয়ার এই ভারসাম্যহীনতা পরিবেশে বিরুপ প্রভাব ফেলবে। এসটিই মনে করে, প্রকৃতি প্রদত্ত যশোর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ বিলুপ্ত হলে যশোরের প্রাকৃতিক পরিবেশ হমকির মুখে পড়বে।

যশোরের খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে এসটিই নামের একটি অলাভজনক সংস্থা। সংস্থাটি যশোরের চৌগাছা ও ঝিকরগাছা উপজেলার ৬৫০ জন গাছির সাথে সরাসরি সাক্ষাত করে যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড় ও গাছি পেশা রক্ষায় করণীয়, সমস্যা ও সম্ভাবনা  বিষয়ক একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। সমীক্ষায় উঠে এসেছে বিচিত্র সব তথ্য।

যশোরের জেলাব্রান্ড পণ্য ও  ঐতিহ্য খেজুর গুড় কমে যাওয়ার পেছনের অন্যতম কারণগুলো এসটিই’র সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে জমির পরিমাণ হ্রাসের কারণে খেজুর বাগান উচ্ছেদ, তরুণ প্রজন্ম গাছি পেশায় না আসা, ইট ভাটার জ্বালানী হিসেবে খেজুর গাছের ব্যবহার, গাছি পেশাজীবীদের প্রতি নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, স্বল্প সময় ও পরিশ্রমে অন্য পেশায় অধিক আয় প্রভৃতি।

এজন্য সরকার যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে যশোরের এই ঐতিহ্যটা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে। সাথে সাথে ঐতিহ্য রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যশোরের প্রান্তিক দরিদ্র শ্রেণির গাছি পেশাজীবীদের সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পৃষ্টপোষকতা দিতে হবে।

লেখক : সংগঠক ও গবেষক ।