চুনিয়া গ্রাম, করোনাকাল ও কৃষিকাজ

Looks like you've blocked notifications!

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার চুনিয়া গ্রামের রুবিনা রেমা ও বিউটি মৃ আগেই অভাব-অনটনে স্কুল ছাড়েন। চাকরি নেন ঢাকার এক বিউটি পার্লারে। তা-ও প্রায় বিশ বছর। ২০১১ সালে চাকরি ছেড়ে দুজন ঢাকার ফার্মগেটে দেন ফিমেল বিউটি পার্লার। গ্রামের চার দরিদ্র গারো নারীও চাকরি পান। মার্চের প্রথমে পশ্চিম রাজাবাজারে অফিস স্থানান্তর করেন। হাতের সম্বল ৬০ হাজার টাকা দেন জামানত। শুরু হয় করোনাকাল। ২২ মার্চ যান গ্রামে।

হাতের টাকা শেষ। কবে পার্লার খোলা যাবে জানা নেই। বাড়ি-ভিটে ছাড়া জমি নেই। পেটের তাগিদে তাই দিনমজুরি করছেন। তাঁদের কথা, জীবন চালানোর তাগিদে বসে থাকলে কি হবে? একই গ্রামের থানছি মৃ। গরিব নানা-নানির কাছে মানুষ। অভাবী সংসারের হাল ধরতে সাত বছর আগে বিউটিশিয়ানের কাজ জোগান। ১৫ মার্চ পার্লার বন্ধ হয়। মাস শেষ না হওয়ায় বেতনটা পাননি। শূন্য হাতে বাড়ি ফেরেন থানছি। মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজে পরিবারের প্রধান নারী। সূত্রমতে, রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা শহরে বিউটি পার্লারে কাজ করেন প্রায় আট হাজার গারো নারী। শুধু পার্লার নয় , তৈরি পোশাকশিল্পসহ শ্রমনির্ভর বিভিন্ন পেশায় রয়েছেন তাঁরা। তবে সরকারি চাকরি, বেসরকারি বড় পদে গারো নারীদের উপস্থিতি হাতেগোনা। এর কারণ শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা। অবশ্য পার্লারে থাকা অল্পসংখ্যক গারো নারী নিজেরা খুব সংগ্রাম করেই উদ্যোক্তা হয়েছেন। করোনা মহামারির সময়ে পার্লারে কাজ করা গারো নারীরা কেমন আছেন?

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিউটি পার্লারে কর্মরত গারো নারীর ৭০ শতাংশের বেশি টাঙ্গাইলের মধুপুর বন, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউরা, মুক্তাগাছা ও নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর এবং কলমাকান্দা উপজেলার বাসিন্দা। শুধু পার্লার নয়, পোশাকশিল্প পেশায়ও অসংখ্য গারো নারী কাজ করছেন। পোশাকশিল্পে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা নেই। চট্টগ্রাম ও সাভার ইপিজেডে গারো নারীকর্মী আছেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে কৌণিক স্প্রে ও ড্রেসার, ব্লাশন আর সফট ব্রাশে ফেসিয়াল, হেয়ার ড্রেসিং ও রিবন্ডিং মেকআপে মানবীকে অপ্সরীর মতো সাজানোর কাজ করেন বিউটিশিয়ানরা। করোনাভাইরাসের কারণে তাঁদের হাতে এখন কোদাল ও কাস্তে। রোদে পুড়ে বাঁচার লড়াই করছেন তাঁরা। করোনা প্রান্তজনের জীবিকাকে কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর,  ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউরা, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা উপজেলার অনেক বিউটিশিয়ান কর্মসংস্থান হারিয়ে নিজ নিজ গ্রামে বসবাস করছেন।

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলা। গ্রামের নাম চুনিয়া। সারি মাটির ঘর। তাতেই বসবাস গারোদের। মধুপুর উপজেলার এ গ্রাম বিউটিশিয়ানের গ্রাম বলে পরিচিত। বাড়ি-ভিটে ছাড়া জমি নেই অনেকের। পেটের তাগিদে তাই এখন দিনমজুরি করছেন অনেকে। জবা আডেং, বিউটি মৃ, জিতি পাতাংসহ ছয় বিউটিশিয়ান এখন কলাবাগানে কাজ করছেন। ভুটিয়া গ্রামের লিমা ম্রং, অপর্ণা সাংমা, ইতি চিশিম, রুপালি চিশিম আনারস বাগান নিড়াচ্ছেন। কাকড়াগুনি গ্রামে বোরো ধান কাটছেন প্রিয়া নকরেক, অর্চনা নকরেক ও শবনম চিরান। এঁদের মজুরি ২০০-২৫০ টাকার বেশি নয়। ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাট, ধোবাউরা ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর এবং কলমাকান্দা উপজেলার পার্লারে কাজ করা বিউটিশিয়ানদের অবস্থা খুবই খারাপ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহে চার দিনের বেশি কাজ মেলে না তাঁদের। জমিজমা ও বাড়ি-ভিটের একাংশ বেচে ছোটোখাটো পার্লার দিয়েছিলেন। করোনায় তাঁরা পথে বসেছেন। অফিস ও বাসা ভাড়ার বকেয়া জমছে। তবে গারো নারীদের জীবনযাপন ও আয়-রোজগারে নগর-মহানগর স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেনি। করোনা আজ সেটাই নতুন করে প্রমাণ করল। মধুপুরের শালবনে তাঁদের যে সনাতন জীবন-ব্যবস্থা, সেটি ধসে পড়েছে প্রাকৃতিক বন উজাড় হওয়ার কারণে।

চিরায়ত জীবন-জীবিকা চ্যালেঞ্জে পড়ায় নগরজীবনে মিশে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা তাঁদের। কিন্তু মার্চে করোনায় বেকার হয়ে অনেকেই বাড়ি ফেরেন। শুরু হয় অর্থনৈতিক দৈন্যদশা। বিউটিশিয়ান এসব গারো নারী বর্তমানে নিজ এলাকায় কৃষিকাজ করছেন। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এসব গারো বিউটিশিয়ানসহ কর্মজীবীদের মানবিক জীবনযাপন নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ভাবনার প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই।

লেখক : সাবেক গণমাধ্যমকর্মী