জিপিএ ৫ না পেলেই জীবনটা বৃথা নয়

Looks like you've blocked notifications!

নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করে ২০২০ সালের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) এবং সমমানের ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। সার্বিক বিচারে পরীক্ষার ফলাফল যথেষ্ট সন্তোষজনক। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির বিষয়টি শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা এবং স্বস্তির বিষয়কে অনেকটা স্বাভাবিক করেছে। খুব ন্যায্যভাবেই এমন ভালো ফলাফলের খবরটি আমাদের জন্য আনন্দের। অবশ্য এবার যে ভালো ফলাফল হয়েছে, সেভাবে  সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়েনি। অপেক্ষাকৃত অধিক জিপিএ ৫ পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী, যারা জিপিএ ৫ পায়নি, তারা কিছুটা হতাশ হয়ে উঠতে পারে।

স্বাভাবিকভাবেই আমরা লক্ষ করি, শিক্ষার্থীরা জিপিএ ৫ না পেলে অনেক ক্ষেত্রে হতাশ হয়ে ওঠে। তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাদের ব্যর্থ প্রমাণ করে ফেলে। কিন্তু বাস্তবে কি তারা ব্যর্থ হয়? এ কথা ঠিক, উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আসন সংখ্যা এবং উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় এ সংক্রান্ত সমীকরণ মেলানো কিছুটা জটিল। জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী মানসিকভাবে যতটা এগিয়ে থাকবে, তার বাইরে অন্য শিক্ষার্থীরা তেমনটা না-ও থাকতে পারে।

তবে বাস্তবতা একটু ভিন্ন। আমার মনে হয়, এমনটি মোটেও নয়। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়, তখন খেয়াল করে দেখেছি মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ ৫ পায়নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। আবার এসব শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করে দেশ ও জাতির জন্য যথেষ্ট খ্যাতি বয়ে আনছে। তারাই একদিন দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হচ্ছে।

আমার মনে আছে, সম্ভবত ২০০১ সালে প্রথম মাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রেডিং সিস্টেম চালু হয়েছিল, সে বছর জিপিএ ৫ পেয়েছিল হাতেগোনা কয়েক জন। আবার যারা জিপিএ ৫ তো দূরে থাক, কোনোরকমে জিপিএ ৩ পেয়েছিল, সে শিক্ষার্থীও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দেশের সেরা একজন হতে পেরেছিল। আমরা অনেকেই মনে করি, পরীক্ষায় কেউ ভালো ফলাফল করলেই সে মেধাবী। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা আপেক্ষিক। আমরা যারা অভিভাবক, তারা যেমন ক্রিকেট খেলা দেখতে গেলে সাকিব কিংবা মুশফিকের কাছে সর্বোচ্চটা আশা করি; তেমনই আমরা আমাদের সন্তানদের পরীক্ষা দিতে পাঠাই প্রত্যাশার পারদ মাথায় চাপিয়ে দিয়ে। আমরাও তাদের কানের কাছে ক্রমাগত বলে যেতে থাকি, তোমাকে প্রথম হতে হবে। যেন পরীক্ষায় সেরা না হতে পারলে জীবনই বৃথা।

আমরা যদি একটু অন্যরকম ভাবতাম! সন্তানদের ক্রমাগত না বোঝাতাম পিইসি, জেএসসি, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলই জীবনের চূড়ান্ত প্রাপ্তি নয়। তা হলে হয়তো এই প্রজন্ম, যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা একটু সহজ ছন্দে জীবনে চালাতে পারত। এত মানসিক অবসাদ, এত হতাশার মুখোমুখি এই প্রজন্মকে হতে হতো না।

আসলে এ জীবনের সবকিছুতে, চাকরিতে, প্রেমে আমরা পরীক্ষার মার্কশিটকেই একমাত্র পাসপোর্ট হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছি বা নিজেরাও শিখেছি, তাতেই বোধহয় বেশি গোলমাল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমরা তো সিনেমায় হিরোকে সব সময়ই সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে দেখিনি। তবুও কেন আমরা নিজেরা সিনেমা দেখতে গিয়ে নিজেকে হিরো ভেবে নিই। সেই সিনেমায় হিরো হয়তো একজন নেহাতই ছাপোষা ছাত্র, কিন্তু সে-ও বেচারা প্রেমে পড়ে। ধনী লোকের সুন্দরী মেয়েটাও তার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।

আমরা যে সন্তানকে সব সময় কানের কাছে গিয়ে বলতাম, তোমাকে প্রথম হতে হবে, তোমাকে জিপিএ ৫ পেতে হবে; সেই সন্তান যদি জিপিএ ৫ না পায়, তাহলে তার জীবন কি বৃথা হয়ে যাবে? হয়তো যাবে না। কিন্তু তাকে যে শঙ্কা এবং হীনমন্যতা আঁকড়ে ধরবে, সেখান থেকে বের হয়ে আসাটা নিশ্চয়ই সহজ হবে না।

সন্তান জিপিএ ৫ না পাওয়ায় আমরা অভিভাবকেরা হতাশ হয়ে উঠি। কিন্তু একবারও চিন্তা করি না পরীক্ষার ভালো ফলাফলই জীবনের সবকিছু নয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন পড়াশোনায় এতই খারাপ ছিলেন যে তাঁকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। স্কুল থেকে দেওয়া চিঠিতে লেখা ছিল, ‘টমাস পড়াশোনায় খুবই অমনোযোগী এবং তার মেধাও ভালো নয়। এ ধরনের ছাত্রকে স্কুলে রাখা সম্ভব না।’ কিন্তু টমাসের মা চিঠিটা খুলে ছেলেকে পড়ে শুনিয়েছিলেন, ‘টমাসের মেধা সাধারণ ছাত্রদের চেয়ে অনেক বেশি। এমন মেধাবী ছাত্রকে পড়ানোর ক্ষমতা সাধারণ স্কুলের নেই। অতএব, তাকে যেন বাড়িতে রেখে পড়াশোনা করানো হয়।’ মায়ের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে টমাস জটিল জটিল বিষয় পড়া শুরু করেন। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি দশ হাজার বারেরও বেশি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে তা আবিষ্কার করেন, থেমে যাননি। কারণ, তাঁর মা তাঁর মধ্যে এ বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। মায়ের মৃত্যুর বহু পরে টমাস স্কুলের সেই চিঠিটি খুঁজে পেয়েছিলেন। চিঠিটি পড়ে তিনি ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘টমাস ছিল একজন মেধাহীন শিশু। একজন অসাধারণ মায়ের অনুপ্রেরণায় সে হয়ে ওঠে যুগের সেরা মেধাবী।’

কাজেই, পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য আমরা আমাদের শিশুকে মানসিক চাপে না ফেলে আসুন উৎসাহিত করি। অল্পতে সন্তুষ্ট হয়ে শিশুর আগামীর যাত্রাকে পরিচ্ছন্ন করি। শঙ্কা ও হীনমন্যতা যেন আমার সন্তানকে আঁকড়ে না ধরে, তেমন সচেতনতাই বাঁচাতে পারে সন্তানের ভবিষ্যৎকে। সর্বোপরি, এই দেশ কিংবা জাতিকে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়