তারুণ্যের বাংলাদেশ
আজ যে কয়টি পত্রিকা বের হয়েছে, সেসবের প্রথম পাতায় নতুন বছরের প্রত্যাশায় দেশের বিশিষ্টজন সবচেয়ে বেশি আশা রেখেছেন তরুণদের ওপর। তাঁরা বলছেন, এই তারুণ্যকে বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দেশবাসীকে বিজ্ঞান ও গণতন্ত্রমুখী করে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
চারদিকে তাকালেই আমরা সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই তরুণদের। এ দেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। বাংলাদেশে রয়েছে চার কোটি ৭৬ লাখ তরুণ-তরুণী। এই তরুণরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে।
জনসংখ্যার এই বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন সোনালি সময় পার করছে। আমাদের নির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি। জনসংখ্যার ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী এখন শতকরা ৬৮ ভাগ। জনমিতির পরিভাষায় এটাই হলো একটি দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। কোনো জাতির ভাগ্যে এ ধরনের জনমিতিক সুবর্ণকাল একবারই আসে, যা থাকে কমবেশি ৩০-৩৫ বছর। বাংলাদেশ এই সোনালি সময়ে পদার্পণ করেছে আরো সাত বছর আগে (২০১২ সাল থেকে), যা শেষ হবে ২০৪০-এর দিকে। এর পর থেকে আবার কর্মক্ষম জনসংখ্যার চেয়ে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে। জনমিতির হিসাবে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে একটি রাষ্ট্রের জন্য উৎপাদনশীল, কর্মমুখী ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সক্রিয় বিবেচনা করা হয়। এ জন্য একটি দেশের মানবগোষ্ঠীর এই পর্যায়কে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য মানবপুঁজি হিসেবে দেখা হয়।
নতুন বছরে সবার চাওয়া, হাল ছেড়ে না দিয়ে তরুণরা জীবনের মোকাবিলা করুক। আত্মবিশ্বাস থাকলেই তরুণরা নিজেদের শ্রদ্ধা করবে। শ্রদ্ধা করবে অন্যদের, সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, শ্রদ্ধা জাগানোর এই ভাব প্রচার করা হবে কীভাবে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
একটা হতাশার কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয় যে আমরা পারছি না। পারছি না ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ঠিকমতো নিতে। উল্টো আমাদের তারুণ্য ধাবিত হচ্ছে নিম্নগামিতায়। সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের নিরন্তর ক্রমাবনতি ঘটছে। রাজনৈতিক সহিংসতায়, বিভাজনে এবং নানা পারিপার্শ্বিকতায় অপ্রীতিকর বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই চলেছে না। বিশেষ করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন সব অভাবনীয় ঘটনা ঘটে চলেছে কোনো কোনো উপাচার্য বা শিক্ষকের কারণে, তখন মনে হয় তারুণ্য যেন নিপতিত হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত কার্যকলাপে। বলতেই হচ্ছে, এটা নিরন্তর চলতে থাকতে পারে না, কোথাও একটা সীমা টানা দরকার।
আমরা গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কর্মকাণ্ড দেখেছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা দেখতে দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি; পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ বছর পর হল ও ছাত্র সংসদ ডাকসু নির্বাচন হয়েও ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের কার্যকর কোনো উন্নতি দেখছি না। এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত টানা যাবে। বুয়েটের কৃতী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা, ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মতো সীমাহীন অভব্যতা ও অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতার ঘটনা আমাদের অন্তরে সমাজের উন্নতি নিয়ে সংশয় তৈরি করে। সত্যিকারের বিবেকবান, স্পর্শকাতর মানুষ এসব দেখলে লজ্জায়, সংকোচে, অসহায়তায় কুঁকড়ে যায়। তারুণ্যের এই বিপন্ন দশা আমাদের সাহস জোগায় না বড় স্বপ্ন দেখতে।
তাই বলতেই হয়, আমাদের বিশাল এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো সহজ কাজ নয়। নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই এ কাজে এগোতে হবে। এই সুবিধা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে আমাদের সামনে। বর্তমানে আমাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় সতেরো কোটি। যদি ১৫ বছর ধরে হিসাব করা যায়, তবে আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশই সবচেয়ে কর্মঠ ও সক্রিয়। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যুবসমাজ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। সরকারি হিসাবই বলে দিচ্ছে, বেকার বড় আকার নিচ্ছে ক্রমাগত। বেকারত্ব উন্নত-অনুন্নত সব দেশের জন্যই কঠিন চ্যালেঞ্জ। সারা বিশ্বেই বিগত বছরগুলোতে বেকারত্বের হার বেড়েছে।
বেকারত্ব দূর করতে চাকরিই একমাত্র সমাধান নয়। আমরা আমাদের সতেজ, ছটফটে তারুণ্যকে কোন পথে নেব, তার একটা ভাবনা প্রয়োজন। আমরা কি হিংসার উল্লাস চাই, না সৃজনশীলতা চাই; সেটা ঠিক করতে হবে।
একটা বড় জায়গা হলো রাজনৈতিকভাবে একটা উদার ও অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করা। অন্যথায় তারুণ্যকে বিপথে নেওয়ার জন্য মৌলবাদী সহিংস গোষ্ঠী তৈরিই আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী যে চক্র, সেই মৌলবাদী গোষ্ঠীর গোষ্ঠীতন্ত্র, অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদ এবং তার বীভৎস রূপ হলো ভয়ংকর জঙ্গিবাদ। দেশের তারুণ্য আজ নানাভাবে সংকটে নিমজ্জিত। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জায়গায় আমাদের এসব তরুণের যথাযোগ্য মর্যাদা নিশ্চিত করাই হোক রাজনৈতিক দর্শন। সময় এখন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এই অপার সম্ভাবনাময় তরুণদের নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করার। এ ক্ষেত্রে তারুণ্যের চাহিদা ও স্বপ্নকে মূল্য দিতে হবে। তরুণদের জন্য দেশের নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে নিতে হবে সৃজনশীল উদ্যোগ। পৃথিবীতে যত বড় বড় কাজ হয়েছে, তার মূলে আছে আত্মবোধ ও আত্মবিশ্বাসের জাগরণ। আমরা আমাদের তারুণ্যে সেই বোধ আর বিশ্বাসটাই চাই।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা