তুরস্ক-গ্রিসের মধ্যে উত্তেজনা ও প্রভাব

Looks like you've blocked notifications!

পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকায় তুরস্কের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান তৎপরতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়ায় তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। অবশ্য তুরস্ক গ্রিসকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে আহ্বান জানালেও সন্তোষজনক কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। উভয় দেশই নিজ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে অব্যাহত রাখায় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় সামরিক মহড়া চালানোর পর উত্তেজনা আরো বেড়েছে। এমনকি ওই অঞ্চলে তুরস্ককে মোকাবিলা করতে ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান কিনতে আলোচনা চালাচ্ছে গ্রিস। ফ্রান্সও গ্রিসকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। অন্যান্য দেশ থেকেও সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র কিনছে গ্রিস।

আমরা লক্ষ করেছি, তুরস্ক সব সময়ই আঞ্চলিক জ্বালানি শক্তি হয়ে ওঠার দিকে বিশেষ মনোনিবেশ করে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তুরস্কের অবস্থান সব দিক থেকেই যথাযথ। এর দুই পাশে তেল-গ্যাস উৎপাদক মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ ককেশীয় অঞ্চল এবং জ্বালানির ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। আর এ অবস্থানগত সুবিধাই হলো তুরস্কের হাতে বড় অস্ত্র।

এই মুহূর্তের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন করতে কষ্ট হবে না যে, তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যকার উত্তেজনা কিংবা সংঘাতের একটি বিশেষ বৈশ্বিক মাত্রা রয়েছে। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তুরস্কের ভাগ্যও এর সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভাগ্যবিধাতা কে হবে, তা-ও নির্ধারণ করবে এ যুদ্ধ। ফলে বিশ্বের অন্য প্রধান শক্তিগুলো ভূমধ্যসাগরের এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। গত শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য যেভাবে পৃথিবীর জ্বালানির অন্যতম উৎস ছিল, ঠিক একইভাবে ভবিষ্যতে ভূমধ্যসাগর এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগর ইউরোপের জ্বালানির অন্যতম উৎস হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে সমস্যা তৈরি হয় তখনই, যখন তুরস্ক আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজেদের জন্য এবং তুর্কি সাইপ্রাসের জন্যও ২০০ মাইল স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক এলাকা (ইইজেড) দাবি করে।

তুরস্ক ও ইউরোপের মধ্যকার এ উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পায়, যখন তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে ফ্রান্সের টোটাল এবং ইতালির এনা কোম্পানির তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী জাহাজকে বের করে দেয়। গত বছরের নভেম্বরে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আঙ্কারা লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের সঙ্গে এক চুক্তি করে। এই চুক্তির ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে আঙ্কারা এবং ত্রিপোলির একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে ইউরোপ নড়েচড়ে বসে। চুক্তি নিয়ে ইউরোপ প্রকাশ্যে তার অস্বস্তির কথা জানায় এবং আঙ্কারাকে এ চুক্তি বাতিলের আহ্বান করে। চুক্তির বিষয়ে আঙ্কারা তার অনড় অবস্থানের কথা জানালে, লিবিয়ায় নতুন করে হাঙ্গামা শুরু হয়।

তবে নিমিষেই পরিস্থিতি ঘুরে যাওয়ার বিষয়টি আমরা সব সময় লক্ষ করি। এবারও এর ব্যতিক্রম প্রত্যাশা করাটা ভুল হবে। কয়েক মাস আগ পর্যন্ত সবার নজর ছিল সিরীয় কুর্দিদের ওপর তুরস্কের হামলা নিয়ে। তারপর হুট করেই নজর চলে গেল লিবিয়ায়। এখন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে।

বর্তমানে পশ্চিমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে এরদোগান ও তার দল একেপিকে দেখতে পাচ্ছি। অতীতে পশ্চিমারা সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এবার একটি আপাত বৈধ পন্থা বেছে নিয়েছে। আর এ ‘বৈধ’ পন্থাটি হলো অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে তুরস্কের জনমানুষকে খেপিয়ে তোলা, আর এর মাধ্যমে একেপিকে ভেঙে আঙ্কারার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করা। এটা সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেনের এক ভিডিও বার্তায় ফাঁস হয়েছে। আর এ কাজে এরই মধ্যে অনেকটাই এগিয়ে গেছে পশ্চিমারা। বৈশ্বিক করোনা মহামারি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাবে তুরস্কের অর্থনীতি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ডলারের বিপরীতে অনেকটা অবনতি হয়েছে তুর্কি লিরার। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রভাবে তুরস্ক এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

তবে তুরস্ক এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে চাইলে রাশিয়া ও চীনের সহযোগিতায় সম্ভব হতে পারে। এমনকি এ ক্ষেত্রে বলা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিনদের প্রভাবকে দুর্বল করে চীন ও রাশিয়ার সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা পরিবর্তন করে দিতে পারে তুরস্ক।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়