দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় ডাটাবেজ জরুরি

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। করোনা থেকে মুক্তির জন্য সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। সাধারণ ছুটি, জনসমাগম বন্ধসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি সারাদেশে দরিদ্র পরিবারগুলোকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। করোনার প্রভাবে নিম্ন আয়ের মানুষ বা যারা দিন আনে দিন খায়, তারা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে। বিশেষ করে গাড়িচালক, চায়ের দোকানদার, ফুটপাতের হকার, কৃষক-শ্রমিক, কুলি, মজুর, পোশাক কারখানার কর্মী, মিল-কারখানার কর্মী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী; এমনকি কিছু কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারও জীবন ধারণে হিমশিম খাচ্ছে। এসব নিম্ন আয়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং ওএমএসে ১০ টাকা কেজি দরে চাল, ত্রাণ, কাবিখাসহ বিভিন্ন ধরনের অনুদান দিচ্ছে। সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ অনুদান বরাদ্দ করছে ঠিকই। কিন্তু এসব অনুদান যথাযথভাবে বণ্টনে দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা। এমনকি সরকারের দেওয়া ত্রাণ চুরি করতে গিয়ে কিছু জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা ধরা পড়েছেন। কয়েকজন বহিষ্কারও হয়েছেন।

আসলে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর কোনো সুনির্দিষ্ট ডাটাবেজ নেই। মোট জনসংখ্যার পেশা, বয়স, আয়, পারিবারিক নির্ভরশীলতা প্রভৃতি বিবেচনায় নির্দিষ্ট একটি ডাটাবেজ দেশের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে কত সংখ্যক জনসাধারণ চাকরিজীবী (পেশাভিত্তিক অলাদা আলাদা), গাড়িচালক, রিকশাচালক, চায়ের দোকানদার, ফুটপাথের হকার, কৃষক-শ্রমিক, কুলি, মজুর, পোশাক কারখানার কর্মী, মিল-কারখানার কর্মী, ব্যবসায়ী (ধরন অনুযায়ী) প্রভৃতির যথাযথ তালিকা কিংবা ডাটাবেজ আজ পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। হয়তো এ বিষয়ে পরিসংখ্যান আছে। কিন্তু পরিসংখ্যান আর ডাটাবেজ এক নয়। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কোনো কিছু অনুমান করা যায়। তবে ডাটাবেজের ভিত্তিতে যেভাবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, সেটি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনসাধারণ দিনে এনে দিনে খায়। এদের সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে থাকা দরকার। একটি পরিবারে, একটি মহল্লায়, একটি পাড়ায়, একটি গ্রামে, একটি ইউনিয়নে, একটি শহরে, একটি উপজেলায়, একটি পৌরসভায়, একটি সিটি করপোরেশনে এবং একটি জেলায় আলাদা আলাদা ইউনিটে কত সংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষ ও উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত রয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য কিংবা ডাটাবেজ থাকলে বর্তমান সংকটে চলমান ত্রাণ কর্মসূচি অনেকটা সহজ হতে পারত। একই ব্যক্তি দুবার ত্রাণ গ্রহণ, যিনি প্রকৃত প্রাপ্য, তিনি না পেয়ে অন্য কেউ পাওয়া; শুধু দলীয় ভোটাররা পাওয়া, ত্রাণ চুরি যাওয়া প্রভৃতি নানাবিধ সমস্যা প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে আসছে। উল্লেখ্য, প্রতি বছরই আমাদের দেশ ছোট-বড় কোনো না কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে, বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকেই। ফলে সরকারকে মাঠপর্যায়ে ত্রাণ বিতরণে কাজ করতে হয়।

একটি রাষ্ট্রে কত জন বসবাস করে, কার নাম কী, কার মাসিক আয় কত, কার পেশা কী; এ বিষয়ে একটি ডাটাবেজ করা কঠিন হলেও কাজটি একেবারে অসম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন বাহিনীর সহযোগিতায় দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে এই কাজটি একবার সম্পন্ন করতে পারলে নানা দুর্যোগের মুহূর্তে সরকারের যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রম এবং দুর্যোগকালীন যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হবে। এমনকি বিদ্যমান স্মার্ট কার্ডের (জাতীয় পরিচয়পত্র) ব্যাপ্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ছয় বছর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জাতীয় খানা জরিপ (এনএইচডি) প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি তালিকা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। জরিপের কাজও শেষ। কিন্তু তালিকাটি এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ওই তালিকা হলে দুর্যোগের এই সময়ে ত্রাণ বিতরণ কিছুটা সহজ হতো। সম্প্রতি গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম, পর্যায়ক্রমে পাঁচ কোটি দরিদ্রকে ডাটাবেজের আওতায় আনতে ইতিমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে (সমকাল, ২০ এপ্রিল ২০২০)। জানা গেছে, ২০ এপ্রিল থেকেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ডাটাবেজ তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, শুধু দরিদ্রদের নয়, গোটা দেশের জনসংখ্যাকে একটি জাতীয় ডাটাবেজের আওতায় আনতে পারলে শুধু ত্রাণ বিতরণ নয়, বহুমুখী সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

বর্তমানে দেশে যে সংকট কিংবা মহামারি সৃষ্টি হয়েছে, সেটি নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত। কারো কাছেই কোনো ধরনের দুর্যোগ কিংবা সংকট প্রত্যাশিত নয়। অপ্রত্যাশিত নানাবিধ সংকট কার্যকর সমাধানের লক্ষ্যে টেকসই ও স্থায়ী প্রস্তুতি হিসেবে দেশের জনসাধারণের একটি জাতীয় ডাটাবেজ তৈরির বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়