দেশাত্মবোধ ও বন্ধুতার অনন্য আইকন

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের নিরেট সাক্ষী সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। তিনি বাংলাদেশের ভূমি-উৎসারিত মানুষ নন। তবে এখানকার স্বাধীনচেতা মুক্ত মানুষের তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। এই জনপদের জন্ম-ট্র্যাজেডিকে নিপুণ মুনশিয়ানায় বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন। এমন একজন মানুষ সমাজ-সংসারের চিরায়ত নিয়ম মেনে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন।

বাংলাদেশকে এক অকৃত্রিম ও পরম বিশ্বস্ত বন্ধুকে হারানোর বিয়োগব্যথা বুকে ধারণ করতে হলো। গভীর শোক ও শ্রদ্ধা আমাদের স্বজনের অধিক স্বজন সাইমন ড্রিং।

গত শুক্রবার রোমানিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ বারের মতো বুকভরে শ্বাস নেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। স্ত্রী ফিয়োনা, দুই জমজ কন্যা ইন্ডিয়া রোজ ও আভা রোজকে রেখে বিদায় জানালেন সাইমন।

সময়টা ছিল ১৯৭১ সাল। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার হিসেবে প্রবাদপ্রতিম এই মানুষটি সে সময় কর্তব্যরত ছিলেন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। লন্ডনের হেডকোয়ার্টার থেকে ফোন করে তাঁকে নির্দেশনা দেওয়া হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’

লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করলেও পাকিস্তান কিংবা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সাইমনের কোনও সম্যক ধারণা ছিল না। এমন অবস্থায় তিনি মার্চের ৬ তারিখে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় আসেন। পরদিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা কভার করতে যান।

সেই ঐতিহাসিক দিনে ফুটেজ নেন, ছবিও তোলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম কাছে থেকে দেখেন। ভাষাগত দুর্বোধ্যতায় পুরো ভাষণের কিছু না বুঝলেও লাখো জনতার চোখমুখের অভিব্যক্তি তিনি পড়তে পারেন অনায়াসে। পরে স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘সেদিন মানুষের উদ্দীপ্ত চোখ যেন একেকটা বারুদ ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ইতিহাসের নতুন মোড় নিচ্ছে।’

২৫ মার্চ রাতে সাইমন ড্রিং ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। পাকিস্তানের সামরিক আইন উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে ২৭ মার্চ ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পাঠান তাঁর কর্মস্থল ডেইলি টেলিগ্রাফে। ৩০ মার্চ যা প্রকাশ হয়।

ওই রিপোর্ট সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলাদেশ নামের নতুন ভূখণ্ডে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর কোলাবরেটরদের মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াল নৃশংসতার কথা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশাল জনমত সৃষ্টি হয় পৃথিবীজুড়ে।

এর পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন সাইমন ড্রিং। এ দেশের আলো-জলে জান বাঁচিয়ে দেশের বিরোধিতা করে গণহত্যার প্রতীকে পরিণত হয়েছে কেউ কেউ। আর ভিনদেশি হয়েও বাংলার মানুষের মুক্তিকামনাই হয়ে ওঠে এই মহান মানুষটির প্রধান ব্রত।

সাইমন ড্রিং ২০০০ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন এ দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ে তোলার প্রধান কারিগর হিসেবে। তিনি তাঁর কর্মকুশলতা ও নিষ্ঠা দিয়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের পেশাদার টিভি সাংবাদিকদের। রয়টার্স, টেলিগ্রাফ ও বিবিসির হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ব্রিটিশ এই সাংবাদিক বাংলাদেশি তরুণদের নিয়ে নতুন পথচলা শুরু করেছিলেন। তরুণ সাংবাদিকদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বন্ধুপ্রতিম শিক্ষকতুল্য। সাইমনের নিষ্ঠ শিক্ষার্থী ও সতীর্থরাই আজকাল বিভিন্ন মিডিয়ায় দ্যুতি ছড়াচ্ছেন।

টেলিভিশনে স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সরকারি রোষানলে পড়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। ২০০২ সালে মুক্তিযুদ্ধের এই পরম বন্ধুকে এক রাতের মধ্যেই দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ দাঁড় করানো হয়।

একাত্তর সালে পাকিস্তানি মিলিটারি জায়ান্টরা জোর করে বাংলাদেশ থেকে বের করে দিয়েছিল সাইমনকে। তবু তাঁর প্রাণের বাংলাদেশের মায়া কখনও ত্যাগ করেননি। বঙ্গমানুষকে কখনওই ভোলেননি।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত সাইমন ড্রিংকে ভালোবাসায় স্মরণ করেছেন। তিনি নিজের ফেসবুক আইডিতে সাইমনের আত্মার শান্তি কামনা করে লিখেছেন, ‘আমার অত্যন্ত প্রিয় আর একজন মানুষ চলে গেলেন। সাইমন ড্রিং। আমাদের দেশের আধুনিক টিভি সাংবাদিকতার পথিকৃত। ছিলেন একাধারে একজন সাংবাদিক, তথ্যচিত্র নির্মাতা, টিভি উপস্থাপক। এ দেশে বর্তমানে বিভিন্ন চ্যানেলে আমরা যে সংবাদ উপস্থাপনা দেখি—এ সবই মূলত সাইমন ড্রিংয়ের অবদান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ছিল অসাধারণ ভূমিকা। আর সে জন্যেই তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের বন্ধু।’

লেখক আহমদ ইশতিয়াক দ্য ডেইলি স্টারে লিখেছেন, ‘সাইমন ড্রিং কেবলমাত্র সাংবাদিকতার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ দাতব্য তহবিল দ্যা রেস এসেইন্ট টাইম তাঁর হাতে গড়া। যেখানে ১৬০টি দেশের সাড়ে ৫ কোটিরও বেশি লোক স্বেচ্ছায় অর্থ সংস্থান করেছেন। স্পোর্ট এইড নামের আরেকটি তহবিল ছিল তাঁর। বিশ্বব্যাপী ১২০টি দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ এ তহবিলে দান করেছিলেন, যা ব্যয় করা হয়েছিল আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য। মানবতার সেবক হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন।’

বিবিসিতে কর্মরত অবস্থায় বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেছেন সাইমন ড্রিং। আশি দশকের শুরুর দিকে বিবিসি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে সিনেমা প্রযোজনার জন্য কোম্পানি করেছিলেন। সেখান থেকে বিবিসি ও পাবলিক ব্রডকাস্ট সার্ভিসের জন্য নির্মাণ করেছিলেন বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র। এ ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও লাতিন আমেরিকার ওপর সাইমন ড্রিং বহু অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। এসব প্রামাণ্যচিত্র বা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, পরিচালক ও প্রযোজনায় ছিলেন খোদ সাইমন ড্রিং।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে ২০১২ সালে সাইমন ড্রিংকে সম্মাননা দেয় সরকার।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়ানো সাইমন ড্রিংয়ের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৯৪৫ সালে। তিনি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন ১৮ বছর বয়স থেকে। দেখেছেন ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব।

এই মানুষটি শত ব্যস্ততার মাঝেও বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সখ্য ও বন্ধুতার কথা কখনওই বিস্মৃত হননি। তাঁর জীবনদর্শনের শ্রেষ্ঠতম বাড়ি ছিল আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ।

এই মহান মানুষটি অন্য এক জগতে পা রাখলেন। দেশাত্মবোধ ও বন্ধুতার অনন্য আইকন সাইমন ড্রিং ছিলেন প্রকৃত বাংলাবন্ধু। বাংলাদেশ কখনওই তাঁর এই বন্ধুকে ভুলবে না। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। প্রার্থনা করি মহান ঈশ্বর সকাশে তিনি যেন চির সুশান্তিতে থাকেন। হে বন্ধু, হে প্রিয় আপনার উদ্দেশে রাবীন্দ্রিক নৈবেদ্যটিই ডেডিকেটেড করা থাক—

তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ

ও মোর ভালোবাসার ধন।

দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

ওগো তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার চিরকালের—

ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন,

ও মোর ভালোবাসার ধন॥

লেখক : সাংবাদিক