পদ্মা সেতু
নতুন বাংলাদেশের বিস্ময়কর প্রতীক
একাত্তরে বীর বাঙালি হানাদারের কাছে পরাভব মানেনি। মাথা নত করেনি বিরুদ্ধ বিশ্বসভায়। বয়স পঞ্চাশের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে সেই বিশ্ব আরেক বার দেখল আমাদের অমিত সাহস। জানল, আমরাও ভাঙতে পারি পরনির্ভরশীলতার অশ্রেয় অচলায়তন।
বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প আমরা আমাদের নিজেদের অর্থেই বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছি। আমাজানের পরে সবচেয়ে খরস্রোতা নদী পদ্মার দুই পাড়কে আমরা একসূত্রে গেঁথে দিতে পেরেছি। সুন্দর ও সহজ যোগাযোগে এপার আর ওপারের মানুষের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক ও হার্দিক মেলবন্ধন গড়ে দিতে পেরেছি। পদ্মা সেতু তাই আমাদের অসীম সাহসিকতা ও কালজয়ী সক্ষমতার বিস্ময়কর প্রতীক।
বাংলাদেশের দূরদর্শী নেতৃত্ব, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অমিত সাহস, দৃঢ় প্রত্যয়, আন্তরিক সদিচ্ছার সুবর্ণস্মারক এখন আমাদের পদ্মা সেতু। আড়াই দশক আগের স্বপ্ন গত ১১ বছরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখন বাস্তবিক ও সত্যি। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় যোগাযোগ প্রকল্প পদ্মা সেতু এখন আমাদের জাতীয় গর্ব। আত্ম-অহংকারের অনন্য উদাহরণ।
বিশ্বব্যাংক ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা, যারা দুর্নীতির বায়বীয় অভিযোগ তুলে এই মেগা প্রজেক্ট থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল, যেসব বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদ ও বিদ্বজ্জনেরা পদ্মা সেতু নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, দ্বিধান্বিত ছিলেন; সে সব কূটনীতিক ও বোদ্ধারা এখন অকুণ্ঠ প্রশংসা করছেন। বলছেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যাবে।
যে সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, তাঁরাও এখন সেতুর সূত্রপাত বা ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচনে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে বাহবা কুড়াবার প্রয়াস পাচ্ছেন। ভবিষ্যতের রাজনীতিতেও এটি দারুণভাবে আলোচনায় থাকবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার উঠে আসা এই সেতুটি নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই সেতু বাংলাদেশের জন্য একটি নেশন বিল্ডিং প্রজেক্ট। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সড়ক পথে যুক্ত করবে এই সেতু। বদলে দেবে অর্থনীতির চেহারা। ঘুরে যাবে বঞ্চিত মানুষের ভাগ্যের চাকা।
পদ্মা নদীতে স্রোতের তোড়ে সরে যাওয়া নরম মাটির পরিমাণ বেশি বলে এই সেতুটি পৃথিবীর গভীরতম পাইলের সেতুর তকমা পেয়েছে। এই সেতু নির্মাণে কারিগরি ও প্রযুক্তি সহায়তা, উপাদানসমূহ, লোহা, রড, সিমেন্ট এমনকি রং ও লাইটিং সামগ্রী বাইরের দেশ থেকে আনা হয়েছে। মানের ক্ষেত্রে কোনও আপোস করা হয়নি।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক রাজনীতি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, ডিজাইনের বিশেষত্ব, নদীর তীব্র স্রোত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, খরচের বাহুল্য সব মিলিয়ে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিরাট ঝক্কি-ঝামেলা পার হতে হয়েছে এই সেতু নির্মাণে যুক্ত ব্যক্তিদের।
এই সেতু তৈরিতে এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ বিশ্বে এর খুব একটা হয়নি।
ফলে সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পরেও প্রতিটি মুহূর্তে নানান ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে সেতু নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্টদের। কার্যত বিরাট এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতাই আমাদের আত্মমর্যাদার পালে হাওয়া দিয়েছে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরিয়তপুরের জাজিরার বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস ঘুচিয়ে দিয়ে মিলনাত্মক অভিধাকে বরণ করে নিল আজ।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, শিল্প ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে উদ্যোক্তাকে ফেরির বিড়ম্বনায় হতোদ্যম হতে হয়েছে, মাছ চাষি, সবজি ও ফল উৎপাদনকারী যে কৃষক ঢাকার বাজার ধরতে না পেরে ফড়িয়া বা দালালের কাছে পুঁজি খুইয়েছেন, তাঁদের জন্য মহা খুশির দিন। মাত্র ছয় মিনিটে তাঁরা প্রমত্তা পদ্মা জয় করে রাজধানীবাসীর দোরগোড়ায় টাটকা পণ্য পৌঁছে দিতে পারবেন।
নদীকেন্দ্রিক কিছু পেশাজীবী হয়তো কর্মসংস্থান হারাবে, কিন্তু কৃষক, ব্যবসায়ী ও খামারিদের হাত ধরে পুরো অঞ্চলজুড়ে কৃষি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তনের আশা করা হচ্ছে। সেই সাথে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বিশ্বমানের যে সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই পর্যটকবান্ধব হয়ে ওঠবে।
জটিল সংকটে পতিত জাজিরা প্রান্তের যে মানুষ আধুনিক চিকিৎসা সেবার জন্য সময়মতো ঢাকায় পৌঁছতে না পেরে তাঁদের স্বজন হারিয়েছেন, যে তরুণ নদী পারাপারের ধকল সামাল দিয়ে ঢাকার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করতে পেরে মূল্যবান চাকরি খুইয়েছেন, যেই কর্মবীর ঈদ-পার্বণে বাড়িতে স্বজনের কাছে পৌঁছতে দুর্মর ধকল সয়েছেন; তাঁদের কাছে পদ্মা সেতু নিশ্চিতই অভাবনীয় উপহার।
পদ্মা বহুমুখি সেতুতে অচিরেই রেল লাইন স্থাপন হতে যাচ্ছে। এতে সহজ যোগাযোগের অপর একটি দিগন্ত উন্মোচিত হবে। পদ্মা সেতু তার বহুমাত্রিক সেবা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকবে। বিশ্বের সাথে সংযুক্ত হতে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়াও ত্বরান্বিত করবে।
আজকে পদ্মায় প্রথম সেতুটি উদ্বোধনের মধ্য দ্বিতীয় সেতু তৈরির স্বপ্নটাও আরও পোক্ত হলো। আগামীর সেই সেতুতে আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা দিতে জাপান উন্মুখ হয়ে আছে সেটাও ইতোমধ্যে তারা জানিয়ে দিয়েছে।
বাড়তি টোল নিয়ে সমালোচনা থাকলেও পরিবহণ ব্যবস্থাতে এই সেতুটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর এভাবেই একটি সেতু হয়ে ওঠবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অসাধারণ সোপান। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনবদ্য আইকন।
নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-পুরুষের বৈষম্য রোধ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যুর হার কমা, কৃষি উৎপাদনে মাইলফলকসহ নানা সূচকে আমরা কেবল অগ্রগামী নই, বরং দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অগ্রগণ্য।
এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স আ্যন্ড বিজনেস রিসার্চ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল-২০২১ শীর্ষক তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে এমন পূর্বাভাসই দিয়েছে।
অনেক বৈরিতার মুখেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তে দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মিত হলো। তাই অনেকের দাবি ছিল সেতুটির নাম যেন ‘শেখ হাসিনা সেতু’ নামকরণ করা হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজের নামে নামকরণের বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে ত্যাগ ও বদান্যতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রকারান্তরে নিজেকেই মহিমান্বিত করেছেন। কার্যত সেতুটির জীবৎকাল ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই জড়িয়ে রইল।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাথে জড়িত দেশি-বিদেশি সবাইকে জানাই প্রাণান্ত অভিবাদন। আমাদের যোগাযোগব্যবস্থার প্রতিটি পদক্ষেপে আপনাদের নাম সুবর্ণ অক্ষরে লেখা হয়ে রইল। বাংলাদেশের ইতিহাস আপনাদের কথা বলবে। আপনাদের জয়গান করবে।
যত বাধাই আসুক। নামুক খরা ঝড় বৃষ্টি বাদল। তবু সুকান্ত ভট্টাচার্য আমাদের তাঁর দুর্মর পূর্বাভাস দিয়েই যাবেন—
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয় :
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
লেখক : সাংবাদিক