নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশ তার গানের সুবর্ণপুত্র এন্ড্রু কিশোরকে বরণের ডালি সাজিয়ে চিরকালের জন্য আপন কোলে ঠাঁই দিল। এই ভূমি পরম মমতায় তাঁর আপনার জনকে নিজের সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিল। গানই যাঁর জীবন-মরণ ও প্রাণ ছিল, মহাপ্রকৃতি সেই গানের বাজিকরকে কী যে এক মায়ায় নিজের সুরের বাঁধনে বেঁধে নিল!

রাজশাহীর গর্বিত মাটি তার সন্তানকে পেয়ে গেল কাল থেকে কালান্তরের জন্য। আর ভক্তের গানে তার প্রিয়াস্পদ শিল্পীর সুর ও সাধনা বেজে চলবে অনন্তর থেকে অনন্তে।

এন্ড্রু কিশোরের গান আমরা প্রাণমন ঢেলে দিয়ে ভালোবাসতাম, তিনি আমাদের বড় আপন ছিলেন। এক অমোঘ নিয়মে দয়াল যেদিন আমাদেরও ডাক দেবেন, সেদিন কোনো এক নতুন মহাশূন্যে এক অচিন বিরিক্ষির ডালে গানের পাখি হয়ে নিশ্চয়ই এই চিরকিশোরের সুরসাধনার সাক্ষী হব আবার নতুন করে।

গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানাই প্রিয় শিল্পীর প্রতি। শোকাহত আমরা। এমন মহৎ শিল্পীর জন্য অশ্রুজলের সাগর গড়ছি আজ।

অসুস্থ অবস্থায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান এন্ড্রু কিশোর। সেখানে ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শরীরে নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি নিজের ইচ্ছায় দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশে গিয়ে মরতে চাই, এখানে নয়।’

স্বপ্ন ও ইচ্ছের সঙ্গে শিল্পীর মনোজগতের সহাবস্থান এত সহসা মিলে যাবে তা কে জানত? বিশ্ব চরাচরের মহান অধিপতি যিনি, তাঁর ইচ্ছেতেই তো আসা-যাওয়ার এমন বাস্তবায়ন।

গেল ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফেরেন তিনি। ফিরে যান রাজশাহীতে। নিজের শহর রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাড়িতে ৬ জুলাই সন্ধ্যায় পূর্ণতা পেল তাঁর জীবনের গল্প, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল শিল্পের পথে যাত্রা।

প্লেব্যাক সম্রাটখ্যাত এন্ড্রু কিশোর চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। মুভির নাম ‘মেইল ট্রেন’। পরিচালক শিবলী সাদিক। চলচ্চিত্রের প্রথম গান হিসেবে ওই ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটি। সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। অবশ্য এর দুবছর পর এন্ড্রু কিশোর সবার কাছে পৌঁছে যান। তাঁর গাওয়া ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ মানুষের মুখে ফিরতে থাকে। মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটির সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান।

আলম খানের সুরে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কথায় ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’ গাওয়ার পর সব্যসাচী বলেছিলেন, দেখবেন এ গানটার জন্য জাতীয় পুরস্কার থাকবে। সত্যি তা-ই হয়েছিল। ১৯৮২ সালে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। সেখানেই কাটে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। মা শিক্ষিকা মিনু বাড়ৈ জানতেন, একদিন এন্ড্রু অনেক বড় শিল্পী হবে। কিশোর কুমারের গান খুব পছন্দ করতেন মা। তাই তিনি ছেলের নামের শেষে কিশোর যোগ করেছিলেন। মায়ের স্বপ্নের সঙ্গে কী দারুণভাবেই না সখ্য পেতেছিলেন এই শিল্পী।

আলম খানের সুরে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় ও হিট গান গাইলেও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলী, আনোয়ার পারভেজ, আনোয়ার জাহান নান্টু, সুবল দাস, সত্য সাহা, আবু তাহের, শেখ সাদী খানের সুরেও গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর।

ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা বেগম, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, আবিদা সুলতানা, শাম্মী আখতার, শাকিলা জাফর, কনকচাঁপা, সামিনা চৌধুরী, রিজিয়া পারভীন, বেবী নাজনীন, ডলি সায়ন্তনী, ফাহমিদা নবী, রোমানা ইসলাম, ন্যান্সি, সালমাসহ অনেকের সঙ্গে দ্বৈত গান করেছেন তিনি, যা অনন্য রেকর্ড।

এন্ড্রু কিশোরের তুমুল জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে...

• জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প

• হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস

• ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে

• আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান

• আমার গরুতে বউ সাজিয়ে

• আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি

• আমার বুকের মধ্যিখানে

• তোমায় নিয়ে নাও ভাসিয়ে যাব তেপান্তর

• তুমি যেখানে আমি সেখানে

• সবাই তো ভালোবাসা চায়

• আমি একদিন তোমায় না দেখিলে

• তুমি আজ কথা দিয়েছ

• চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা

• বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে

• তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন

• ভালো আছি ভালো থেকো

• ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা

• ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না

• তুমি আমার কত চেনা

• তুমি মোর জীবনের ভাবনা

• তোমায় দেখলে মনে হয়

মূলত চলচ্চিত্রের গানেই জীবনের বেশির ভাগ সময় দিয়েছেন তিনি। ব্যক্তিগত অ্যালবাম খুব একটা করেননি। চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ইত্যাদিতে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। তারপর বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন তিনি। প্রেম, বিরহ, বিষাদ, হাসির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, বিশেষ করে দেশাত্মবোধক গানে তিনি ছিলেন অতুল্য ও অদ্বিতীয়।

চার দশক ধরে পুরোদস্তুর পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায় গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিখ্যাত সুরকার, সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মণের সুরে ‘শত্রু’ মুভিতে গান করেছিলেন। বোম্বেতে তিনটি বাংলা ও একটি হিন্দি গান গেয়েছিলেন। ‘সুরজ’ নামে হিন্দি গানটা লিখেছিলেন হিন্দি ভাষার খ্যাতিমান গীতিকবি আনন্দ বকসী।

জীবনের শেষবেলায় ক্যানসার নামের প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে এই শিল্পীকে। কিন্তু আদর্শিক দেশাত্মবোধ ও মহত্তম শিল্পের অমরত্ব থেকে কোনো কিছুই তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

অসীম মহাকালে ভক্তের হৃদয়তন্ত্রিতে এক জাদুকরি কলকাকলি হয়ে এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠসুধা নিশ্চিত অনুরণন তুলে যাবে। জীবনের কোনো গল্পই বাকি রাখেননি গানের এই বরপুত্র। পূর্ণতার প্রাপ্তিতে এন্ড্রু কিশোরের শৈল্পিক কর্মনিষ্ঠা তাই পুতঃপবিত্র। শিল্পের শিখা ও আলোকবর্তিকা তাই অনির্বাণ।

প্রাণান্ত ভালোবাসা বাংলাভূমির প্রিয় শিল্পীর প্রতি। নব নব জীবনের গন্ধ রেখে এবং নব নব বিকাশের বর্ণ এঁকে আমাদের অন্তরে তুমি হয়ে রইলে অমিয় সুরের অসাধারণ কবি। রাবীন্দ্রিক এই অবিস্মরণীয় সুরটাই হোক তোমার প্রতি আমাদের প্রাণের প্রগাঢ় নৈবেদ্য ও গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি—

নয়নসমুখে তুমি নাই,

নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই

আজি তাই

শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।

আমার নিখিল, তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন