পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়েছে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের উচ্ছ্বাস
মিনিট, সেকেন্ড, ঘণ্টা পেরিয়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে চলেছে। সেতু উদ্বোধনের আবেগে ভাসছে গোটা বাংলাদেশ। আর সেই আবেগের ঢেউ লেগেছে শহর কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় যত এগোচ্ছে বাঙালির হৃদয়ে যেন পদ্মার পটভূমি চিত্রকরের আঁকা ক্যানভাসে ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। সেখানে কোথায় দুই দেশের সীমানা, কোথায় কাঁটাতার? সব যেন মিলেমিশে একাকার পদ্মা সেতুর বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে। দুই বাংলাই যেন সমানতালে উচ্ছ্বাসে ভাসছে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়া মানেই দুই দেশের দূরত্ব এক লহমায় অনেকটাই কমে যাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ী থেকে পর্যটনের কাজে যাঁরা বছরে বেশ কয়েক বার বাংলাদেশে যাতায়াত করেন, তাঁদের কাছে পদ্মা সেতু উদ্বোধন মহা আনন্দের এক ক্ষণ। যাঁরা ভারত থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন কাজে বছরভর যাতায়াত করেন, তাঁদের কাছেও পদ্মা সেতু মানে আজ আনন্দের এবং স্বস্তির নাম।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ইউটিউবার পঙ্কজ বিশ্বাস কথায় কথায় জানালেন, আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ঐতিহাসিক ক্ষণকে তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে ধরে রাখতে আগের দিন ঢাকায় যাচ্ছেন। ভিসা রেডি করে রেখেছেন। উপস্থিত থাকবেন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে।
শুধু পঙ্কজ বিশ্বাসই নয়, পশ্চিমবাংলা থেকে বহু মানুষই চেয়ে রয়েছেন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দৃশ্য সরাসরি গণমাধ্যমের পর্দায় দেখে ঐতিহাসিক ক্ষণটির সাক্ষী থাকতে।
আজ থেকে ৪২ বছর আগে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসা বর্ধমান গুসকরার শচীন দাস স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা পেছনে ফিরে জানালেন, ‘পদ্মা মানেই বাঙালির আবেগ। যে পদ্মা দিয়ে এপার ওপার করতে একটা সময়ে আমরা ইষ্টনাম জপ করতাম। আজ সেই পদ্মার উপর দিয়ে যাওয়া যাবে এপার থেকে ওপারে। জীবনে শেষ বারের জন্য হলেও পদ্মা সেতু দিয়ে পারাপার করতে একটি বার আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই। এভাবেই পদ্মা সেতুর আবেগ আজ ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবাংলার আনাচে-কানাচে।’
বাংলাদেশ থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা পশ্চিমবঙ্গের কয়েক কোটি মানুষের হৃদয় আজ উদ্বেলিত। পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা ব্যান্ডের কণ্ঠশিল্পী হিমাদ্রী ঘোষ তো পদ্মার নাম শুনেই দুই কলম গেয়ে উঠলেন, পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যারে... বললেন, ‘পদ্মা মানেই আমার হৃদয়ের একটি অংশ। যেই পদ্মার উপর দিয়ে যাব, ভাবতেই গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠছে। এবার আর বিমানে নয়, অবশ্যই স্থলপথে পদ্মার উপর দিয়ে ঢাকায় যাব।’
পশ্চিমবাংলার উঠতি প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে পদ্মা সেতুর আবেগ। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটা সেতুর নিচ দিয়ে ট্রেন, ওপর দিয়ে যানবাহন কী করে যাওয়া সম্ভব, সেই দৃশ্য দেখতে মোবাইলের ইউটিউব আর গুগুল সার্চে তাদের এখন প্রথম পছন্দ পদ্মা সেতু। তাই শুধু বাংলাদেশেই নয়, পদ্মা সেতুর আবেগ এখন পশ্চিমবঙ্গের আবালবৃদ্ধবণিতার মধ্যেও আগ্রহের ঝড় তুলেছে।
পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ী মহল থেকে পর্যটনপ্রেমীদের বক্তব্য, এখন থেকে ঢাকা যেতে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা পদ্মা পাড়ের জন্য ফেরি ঘাটে লাইন দিতে হবে না। প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা আগেই আমরা পৌঁছে যেতে পারব বাংলাদেশের রাজধানীর বুকে। উদ্বোধনের আগেই পদ্মা সেতুর তুলনা যেন সে নিজেই। পদ্মা সেতুর তুলনা আর কোনও সেতুই যেন হতে পারে না। এ বিশ্বাসে আত্ম অহংকারের গর্বিত পশ্চিমবাংলার বহু মানুষই। পশ্চিমবাংলার বাঙালি সমাজ আজ পদ্মা সেতুর গরবে যেন গর্ব অনুভব করছে। বাঙালি যে বিশ্বের সেরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে, তার নমুনা অবশ্যই বাংলাদেশের পদ্মা সেতু। পদ্মার ঢেউ কতটা উদ্বেল সেই বিচারে না গিয়ে এপার বাংলার আপামর মানুষের একটা বড় অংশের হৃদয় পর্যবেক্ষণ করলেই আজ স্পষ্ট বোঝা যাবে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ পদ্মার ঢেউয়ের উদ্বেলতাকে নিঃসন্দেহে ছাপিয়ে যাবে।
শহর কলকাতা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরতলীর সান্ধ্য-সকালের চায়ের কাপে এখন থেকেই তুফান তুলতে শুরু করেছে পদ্মা সেতু। কীভাবে এই অসাধ্য কাজ সম্ভব তার চুলচেরা বিশ্লেষণের সাতকাহন আজ পশ্চিমবঙ্গের চা দোকানের গুমটিগুলিতেও।
বাংলাদেশ ছেড়ে আসা পশ্চিমবঙ্গের বহু উদ্বাস্তুকলোনির বয়োবৃদ্ধদের ছানি পড়া ঝাপসা চোখে আলোর রোশনাই। পদ্মার বুকে সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। এ যে অবিশ্বাস্য এক স্বপ্ন। একটি বার নিজেদের ফেলে আসা দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি আজ তাঁদের চোখেমুখে। আর সেই আকুতিকে হৃদয়ের মন উচাটন আবেগে ফিরিয়ে আনার নামই বোধহয় আজ পদ্মা সেতু। তাই পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয়, পশ্চিমবাংলার বাঙালির কাছেও গর্বের, অহঙ্কারের। যে অহঙ্কারের বাংলা এবং বাঙালি যেন কোথাও বিনাসুতোয় এক মালায় বাঁধা পড়ে গেল।
লেখক : এনটিভি অনলাইনের প্রতিনিধি, কলকাতা