বদলে যাওয়া বাংলাদেশ ও আমাদের চ্যালেঞ্জ
চেনাপথ, চেনা মানুষ—সব যেন বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে প্রতিদিনের রুটিন কাজকর্ম। বদলে যাচ্ছে চিন্তাধারা। বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের রসায়ন মানুষে-মানুষে। পারিবারিক, সামাজিক, স্বদেশ বা প্রবাসে। নভেল করোনাভাইরাসে সৃষ্ট কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির আতঙ্ক বুক ভারী করে তুলেছে। যে ক্ষুদ্র ভাইরাস খালি চোখে দেখা যায় না, সেই অচেনা শত্রুই বদলে দিচ্ছে আমাদের মুখের ভাষা-ব্যাকরণ, আমাদের ব্যবহার।
আমি যেন চেনা পথে অচেনা পথিক
যে পথ ধরে প্রতিদিন চেম্বারে যাই, আজ তা বিবর্ণ মলিন। কোলাহল নেই, রাস্তায় জ্যাম নেই। ওভারব্রিজে মানুষের ঘামের গন্ধ নেই। বাতাসে শুধু অচেনা ভাইরাসের তৈলাক্ত গন্ধ। মনে হচ্ছে, আমি এ শহরের চেনা পথে অচেনা পথিক।
বুকে ব্যথা আছে, কিন্তু তেমন মহামারি না
চেম্বারে এক রোগী এসে বলল, ‘স্যার, বুকে ব্যথা, কিন্তু তেমন মহামারি না।’ আমি অবাক হলাম। বুকের ব্যথা, তা-ও আবার মহামারি বিশেষণ! যাচ্ছি কোথায়। মহামারি কি বদলে দেবে ভাষা-ব্যকরণ? যেমন—কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন। সামনের দিনে শুনব আরো কত কী। পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুপমেন্ট ইত্যাদি।
উপহার
বুয়েটের অ্যালামনাইর ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তারদের উপহার দিয়েছেন। অর্থাৎ লড়াইটা ডাক্তারদের একার না। বন্ধু হয়ে পাশে থাকা।
এ কেমন দেয়াল, এ কেমন আড়াল
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছেন আপনজনকে। এর আগে কখনো কোনো রোগে প্রিয়জনকে এ ধরনের সংগনিরোধে থাকতে হয়েছে বলে জানা নেই বাংলাদেশের। যেখানে দল বেঁধে রোগী দেখতে আসা আমাদের অভ্যাস। সেখানে এ কেমন দেয়াল এ কেমন আড়াল!
স্যার, কতবার হাত ধোবো
মাছ ব্যবসায়ী শরীফ বলছিল, ‘স্যার, আমার হাত তো সারা দিন মাছের পানিতে। আমি কতবার হাত ধোবো?’ উত্তর আপনার জানা আছে কি?
বাক্সবন্দি বিয়ের তারিখ
দীর্ঘদিনের প্রেমের পরিণতি বিয়ে। দিন-তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। মনের দুঃখে কথাগুলো বলছিলেন একজন। বাক্সবন্দি হয়ে গেছে বিয়ের দিন-তারিখ। নিয়মের বেড়াজালে সম্পর্কের মায়াজাল।
লকডাউন ও জীবিকার মহামারি
যেভাবে করোনাভাইরাস তার শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে, তাতে করে ত্রাহি অবস্থা আমাদের। ইতোমধ্যে লকডাউনের মতো পরিস্থিতি শুরু হয়ে গেছে। গোটা দেশে হলে কী হবে সে সময়?
কোয়ারেন্টিন
অনেক বিজ্ঞ মত দিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে যদি আটকে রাখা যেত, তাহলে পরিস্থিতি এত উদ্বেগজনক হতো না। কেউ কেউ বলছেন, হোম কোয়ারেন্টিনের সিদ্ধান্ত ছিল বোকামি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, বিমানবন্দরে টার্মিনাল দিয়ে বেরিয়েই প্রবাসীরা অপেক্ষমাণ স্বজনদের সঙ্গে কোলাকুলি করছে। হোম কোয়ারেন্টিন বিষয়ে সচেতনতার বড়ই অভাব।
করোনাভাইরাসের কারণে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় ওষুধ, কাঁচামাল, মুদির দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট ও গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করেছে। কাগজপত্রে লকডাউন না বললেও এটাই লকডাউন। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দেশে এ ধরনের পদক্ষেপ এটাই প্রথম।
করোনা বিপর্যয় তহবিল
যদি গরিব মানুষকে বাঁচাতে চাই, তাহলে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে করোনা বিপর্যয় তহবিল। একটি নীতিমালার মাধ্যমে এই কাজ করতে হবে।
পিপিই ও ডাক্তার যখন কোয়ারেন্টিনে
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ডাক্তারদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করছে। ভীতি কাজ করছে। যে পরিবেশে কাজ করলে তাঁরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে কাজ করবেন, তার অভাব রয়েছে। পারসোনাল প্রোটেকশন ইক্যুপমেন্ট (পিপিই)-এর যৌক্তিক ব্যবহার প্রয়োজন চিকিৎসকদের মধ্যে, আস্থা ফেরাতে না পারলে সাধারণ মানুষও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে; যা মহামারি মোকাবিলায় এক ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে, ডাক্তারদের কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন ক্লান্ত শরীর নিয়ে। ডাক্তারদের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হবে।
চিকিৎসা গাইডলাইন এবং যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন
চিকিৎসা বা ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন বা প্রটোকল নির্ধারণ করে যথাযথভাবে চিকিৎসকদের দায়িত্ব সমন্বয় করতে হবে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমেও এই কাজটি করা সম্ভব।
করোনাভাইরাস বিষয়ে স্বাস্থ্যবিদদের মতের ভিন্নতা
নভেল করোনাভাইরাসটি নতুন এবং এর সংক্রমণ জনমতে আতঙ্ক তৈরি করছে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যবিদরা নানা রকম তথ্য দিচ্ছেন। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ভাইরাস বাতাসে ৩০ মিনিটের মতো ভেসে থাকতে পারে এবং ১৪.৭ ফুট যাতায়াত করতে পারে, যা আগের মতামতের সঙ্গে তুলনায় অনেক ভিন্ন। এর আগে স্বাস্থ্যবিদরা তিন থেকে ছয় ফুট দূরত্বে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এত অধঃপতন কীভাবে সম্ভব?
নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট কোডিভ-১৯ নামক স্বাস্থ্য সংকটে কিছু মানুষ মানবিক মূল্যবোধের চরমতম অধঃপতনের পরিচয় দিয়েছেন। হাসপাতালে ব্যবহার করা মাস্ক-গ্লাভস শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে আবার প্যাকেট করে বিক্রি করছেন। এই চরম বিপদের দিনে এমন হীন কাজ মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এতটা অধঃপতন কীভাবে সম্ভব? এই নিকৃষ্ট লোকগুলো করোনাভাইরাসের মতোই বাংলাদেশের শত্রু।
বাজারদর ও খাদ্য গুদামজাত
এটা বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে এই সুযোগ না নিতে পারে, এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। দেশের এই ক্রান্তিকালে সবার প্রতি অনুরোধ, মজুদদারি করবেন না। সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল-ডাল কিনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেন না।
শীর্ষ পর্যায় থেকে দিকনির্দেশনা প্রয়োজন
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় শীর্ষ পর্যায় থেকে দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। অনেক দিন চলে গেছে, কিন্তু আমরা দৃশ্যমান শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা এখানো দেখাতে পারিনি। যদিও এখনো আমাদের দেশে ভাইরাসটির দাপটে ইউরোপের মতো নয়। কিন্তু পরিস্থিতি অবনতিশীল হলে বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে। আমাদের করণীয় কী, তা জনগণের কাছে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া প্রয়োজন।
করোনা ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন তৈরি করতে হবে
ধরে নিচ্ছি, এ সংকট বাংলাদেশে আগামী তিন মাস স্থায়ী হতে পারে। এই তিন মাসে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর রূপরেখা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে হবে। যেমন—অর্থনৈতিক, আইনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা।
এই চ্যালেঞ্জগুলো উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ করতে হবে আমরা পারি, তাহলে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে, আতঙ্ক কমে যাবে। সারা দিন ক্যামেরার সামনে যতই বলি আপনারা আতঙ্কিত হবেন না, করোনা কোনো ভীতিকর ভাইরাস নয়।
বিশ্বাসযোগ্য দৃশ্যমান সংকট উত্তরণের ছবি জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমি চিকিৎসা বিষয়ে প্রথমে আসছি। আমরা চীনের মডেল অনুসরণ করতে পারি—‘উহান বাঁচলে হুবেই বাঁচবে। হুবেই বাঁচলে চীন বাঁচবে।’ একইভাবে ঢাকা বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।
বাংলাদেশের সব হাসপাতালে এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। ধরে নিলাম, ঢাকা শহরে একশ হাসপাতাল আছে। এখান থেকে দশটি হাসপাতালকে জ্বর, সর্দি, কাশি সংক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে হবে। এখানে শুধু কোভিড-১৯ সংক্রান্ত রোগীদের আসতে বলতে হবে। এই হাসপাতালগুলোতে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামসহ চিকিৎসকদের নিরাপত্তার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। মনে রাখবেন, নব্বই হাজার চিকিৎসকের জন্য প্রতিদিন যদি একটি করে পারসোনাল প্রোটেকশন ইক্যুপমেন্ট (পিপিই) বরাদ্দ করা হয়, তাহলেও সমস্যার সমাধান হবে না। চীনও এই কাজ করেনি।
চিকিৎসকদের একটি শক্তিশালী টিম তৈরি করতে হবে, যাঁরা এই চিকিৎসায় নিজেকে সমর্পণ করতে চান। তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেসব চিকিৎসককে প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
একইভাবে অন্যান্য সেক্টরেও একই কাজ করতে হবে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমাদের জিততে হবে। বিভাগ, জেলা পর্যায়ে ঝুঁকি বিবেচনায় একটি-দুটি হাসপাতালকে এভাবে সাজাতে হবে। প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার মানুষ বিমানবন্দরে নামছেন। সেখানেই স্ক্রিনিং করে নেওয়া সম্ভব। যেভাবে জানা গেছে শরীয়তপুরে ঝুঁকি বেশি।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করোনা বিপর্যয় তহবিল করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি শিল্পপতিদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে, যদি কোনো কারণে লকডাউনের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তখন গরিব মানুষকে যেন বাঁচিয়ে রাখতে পারি। পরিশেষে বলতে চাই, এ যুদ্ধে হারার কোনো সুযোগ নেই। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। আতঙ্ক কমিয়ে চাই নির্ভার বাংলাদেশ।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়