বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা

Looks like you've blocked notifications!

কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে গত ১৩ আগস্ট ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের চুক্তি হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্মের পর ১৯৭৯ সালে মিসর আর ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছিল ইসরায়েলের। পরিণামে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। মিসর ও জর্ডানের পর আমিরাতই হলো আরব বিশ্বের তৃতীয় দেশ, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করল। ফলে যেসব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের গোপন সম্পর্ক বিদ্যমান, সেসব আরব দেশ প্রকাশ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে নতুনভাবে চুক্তিতে আসতে পারে। বিশেষ করে বাহরাইন, ওমান, মরক্কো, সৌদি আরব ও কাতার এ বিষয়ে ভাবতে পারে বলে আশঙ্কা করা যায়।

যদিও আরব দেশগুলোতে এর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। লক্ষ করলে বোঝা যায়, বর্তমানে মুসলিম দেশগুলো তিন ভাগে বিভক্ত : কিছু দেশ ইরানকেন্দ্রিক। এরা সবাই ইসরায়েলের বিষয়ে শক্ত অবস্থানে। আরেক দল সৌদি আরব ও আরব আমিরাতকেন্দ্রিক। আরেক ভাগ তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান। সাম্প্রতিক এই চুক্তির কারণে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিকভাবে মুসলিম দেশগুলোর বিভক্তি আরো বাড়বে, যার প্রভাবে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের সুযোগ তৈরি হতে পারে।

আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের শত্রুতা ধর্মকেন্দ্রিক। ইরান শিয়া মতবাদ লালন করে আর আরবরা সুন্নি মতবাদ। আমেরিকার মিত্র হওয়ায় ইসরায়েলকে ইরান সর্বদা টার্গেটে রাখে। এবার আমিরাত-ইসরায়েল চুক্তির কারণে ইরান-ইসরায়েল অস্থিরতা আরো বাড়বে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। ইসরায়েলের সেনাপ্রধানসহ অন্য নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন বক্তব্যে এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে, এই চুক্তিতে দুই দেশেরই লাভ—‘মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের ঘোরতর শত্রু ইরান। আমরা একসঙ্গে ইরানকে ঘায়েল করতে সক্ষম হব।’ ইতোমধ্যে ইসরায়েল নিশ্চিত করেছে, দুই দেশ এরই মধ্যে ইরানবিষয়ক গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান শুরু করেছে।

বিতর্কিত এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আরব আমিরাতকে বেশ কিছু দেশ সাধুবাদ জানালেও কড়া কথাও শুনিয়েছে ইরান, তুরস্কসহ আরো কিছু দেশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তুরস্ক সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ভাবছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তবে তুরস্ক এ সমঝোতাকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে আখ্যায়িত করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। কারণ, দীর্ঘদিন ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণেই তুরস্কের এমন প্রতিক্রিয়া মূলত দেশটির দ্বৈতনীতিরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দুই দেশের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাসের ঘটনা ঘটলেও গত বছর তুরস্ক ও ইসরায়েলের বাণিজ্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইসরায়েল হলো তুরস্কের শীর্ষ দশ রপ্তানি বাজারের একটি। এ তথ্যই হয়তো প্রমাণ করে, তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলের একটি বিশেষ যোগাযোগ রয়েছে।

এই চুক্তির বড় একটি প্রভাব পড়বে ভারত ও পাকিস্তানের ওপর। সৌদি-আমিরাতের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ ভালো। এবার ইসরায়েল এদের সঙ্গে যুক্ত হলে নিঃসন্দেহে ভারতও এসব মুসলিম দেশের সঙ্গে হাত মেলাবে। অন্যান্য উপসাগরীয় অঞ্চল, যারা এই চুক্তির পক্ষ নেবে, তাদের সঙ্গেও ভারতের সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। ফলে পাকিস্তান কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। এই সুযোগে সৌদি, আমিরাত, ভারত মিলে একটি শক্তিশালী ঐক্য তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরিতে ভারত-ইসরায়েলের বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর হয়। উপসাগরীয় অঞ্চলগুলো প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উল্লেখযোগ্য বাজার। তাই ইসরায়েল-ভারতের তৈরি প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের চাহিদা ব্যাপক হবে।

তবে যা-ই ঘটুক না কেন, সৌদি আরব আমিরাতের মতো খোলাখুলি ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মেলানোর সম্ভাবনা কম। কারণ, ধর্মীয় দিক থেকে সৌদি হলো মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রবিন্দু। তাই অতীতের অনেক বিষয়ের কারণে সৌদি খোলাখুলি ইসরায়েলের সঙ্গে মিলতে পারবে না। যদিও রাজনৈতিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদির ঘনিষ্ঠতা অনেক বছরের।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ‘ট্রাম্পকার্ড’ খেলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্পকার্ড খেললেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েল ও আমিরাতের চুক্তি আমেরিকার ভোটেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদি এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুও এই চুক্তি থেকে কতটা ফায়দা তুলতে পারবেন, তা নিয়েও সংশয় আছে। কারণ, ইসরায়েলের সাধারণ মানুষ আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তি ভালো চোখে নাও দেখতে পারেন। বিশেষ করে পশ্চিম ভূখণ্ড দখলের যে অঙ্গীকার নেতানিয়াহু করেছিলেন, তা সফল না হলে ইসরায়েলিরা ক্ষুব্ধ হতে পারেন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়