ভোট ছাড়া রাজনীতির আর আছে কী?

Looks like you've blocked notifications!

বহুল আলোচিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুটি অংশের নির্বাচন হয়ে গেল। দুই মেয়র পদেই নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের দুজন, কাউন্সিলর পদেও সরকারি দলের জয়জয়কার। এই নির্বাচনের নানা দিক নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে।

আমি মনে করি, এই নির্বাচনে পাওয়ার দিক আছে অনেক। দুই দলই শিক্ষিত, অপেক্ষাকৃত তরুণ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির মেয়র প্রার্থী দিয়েছে। পুরো নির্বাচনী প্রচারের সময়টিতে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সহিংসতা ছিল না, উৎসবের আমেজ বজায় ছিল। বহুদিন পর বিএনপিকে অনেক মিছিলে, প্রচারে সক্রিয় হতে দেখা গেছে। এই নির্বাচন হয়েছে ইভিএম প্রযুক্তিতে এবং এটি ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যও হয়েছে কিছু ছোটখাটো ত্রুটি প্রদর্শন করেও। নির্বাচনের দিনও পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল, বড় কোনো গোলযোগ ঘটেনি।

এসব প্রাপ্তি সত্ত্বেও বড় অপ্রাপ্তি নির্বাচনে ভোটারদের অনুপস্থিতি। কেন ভোটার কম এলো, এটিই এখন আলোচনার কেন্দ্রে। উত্তরে ভোট পড়েছে ২৩.৬১ শতাংশ আর দক্ষিণে ২৬.৯৫ শতাংশ। বিজয়ী দুই প্রার্থীর কেউই ১৫ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। দুই দলের মিছিল-সমাবেশে যত লোক ছিল, তারা এলেও ভোট আরো পড়ত। তাহলে বলতেই হয়, ভোটের হার কমার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই।

কিন্তু ভোটের হার এবারই এত কম হলো, নাকি অতীতেও হয়েছে? আমার মনে আছে, ২০০২ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটির নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি প্রার্থী সাদেক হোসেন খোকা নির্বাচন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল। সে সময়ের নির্বাচন কমিশন ৩০ শতাংশের মতো ভোট দেখালেও জনশ্রুতি আছে যে, ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি সেই নির্বাচনে।

বিএনপি তার সমর্থক ও ভোটারদের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র স্থাপন করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ তারা খুঁজবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এর দায় দলের নেতৃত্বের। নির্বাচনের শুরু থেকেই বিএনপি নেতারা ইভিএম-বিরোধী কথা বলেছেন, যা সাধারণ ভোটারদের মাঝে একটা প্রযুক্তিবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করেছে। বারবার বলেছেন, তাঁরা নির্বাচন করছেন ঠিকই, কিন্তু জানেন যে তাঁদের জিততে দেওয়া হবে না। এমন বক্তব্য ভোটারকে নির্বাচনে ভোট দিতে আকৃষ্ট করে না। বিএনপি কোনোভাবেই তার ভোটারদের ভোটদানের জেদ তৈরি করতে পারেনি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিলে পাঁচ শতাধিক নেতা আছেন। তাঁদের কাউকে কোনো ভোটকেন্দ্রে দেখা গেছে? ভোট ও ভোটকেন্দ্র বিষয়ে অপপ্রচার, বিশেষ করে ‘কেন্দ্রে গিয়েও ভোট দিতে পারবেন না, দেখবেন ভোটটি দেওয়া হয়ে গেছে’—এই প্রচারণা বড় ভূমিকা রেখেছে। কেন্দ্র দখলের গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার কারণেও ভোটার আসেনি বলে উপস্থিত ভোটারদের কেউ কেউ বলেছেন।

তেমনি আওয়ামী লীগের এত সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন, এত এত নতুন সংগঠন। শুধু নেতারা ভোট দিতে গেলেও এর চেয়ে বেশি ভোট পড়ার কথা। যত পোস্টার-ব্যানার ঝুলেছে, তত ভোটার নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্বাচনী প্রচার চলাকালে বড় দুই দলের ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের পেশিশক্তি প্রদর্শন ভোটারদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে; তারা প্রচারণায় যত আগ্রহী ছিল, ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিল না। অর্থাৎ, সরকারি-বিরোধী দুই দলের কেউই নির্বাচনকে সিরিয়াসলি নেয়নি। একদলের বিশ্বাস ছিল জিতে তো যাবই, আরেক দল প্রথম থেকেই হেরে বসে আছে, যা ভোটারদের ভোটবিমুখ করেছে।

তবে অন্য বাস্তব কারণও আছে। এই শহরে ভাড়াটিয়া ভোটার বেশি। তাদের বাসাবদল নিয়মিত ঘটনা। ভোটের দিন যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় সমান্য দূরের ভোটকেন্দ্রেও মানুষ ভোট দিতে যায়নি। কাল থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। ছুটির দিনে বাবা, মা ও অভিভাবকরা, বিশেষ করে মায়েরা এই সময়টায় সন্তানের কাছে থাকতে চেয়েছে। দুদিনের ছুটি নিকটবর্তী জেলার মানুষকে উৎসাহিত করেছে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে। তবে এসবই শেষ পর্যন্ত জানান দেয় যে, ভোটের প্রতি নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি একটা বড় আস্থার সংকট দানা বেঁধেছে।

যা ভোটার দেখা গেছে, বড় অংশই পঞ্চাশ ও তদূর্ধ্ব বয়সের। তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি অস্বাভাবিকভাবে কম ছিল। এটাকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ঈশান কোণে থমথমে মেঘের আনাগোনা হিসেবে দেখতে হবে। মনে হচ্ছে, নানা কারণে আমজনতা ও ছাত্র-তরুণরা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আর আগ্রহী নয়। বলা হচ্ছে, জ্বলন্ত চুলা আর তপ্ত কড়াইয়ের ফাড়ায় তারা যেতে চায় না। তরুণরা কেন দলে কম আসছেন, তার কারণ কি এই যে, দলসমূহে  সৎ তরুণদের নেতৃত্বের স্বীকৃতি জোটে না? তরুণ-তরুণীরা কেন ভোটকে বরণ করতে চাচ্ছে না, সেই গবেষণা করবে কি দলগুলো? মনে রাখা দরকার, ভোট ছাড়া রাজনীতির আর আছেটা কী?

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা