মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অমুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে
আমাদের সুদীর্ঘকালীন স্বাধীনতার স্পৃহা আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি, জনকল্যাণ গণতান্ত্রিক চেতনা ও একটি সুখী সমৃদ্ধশালী, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত এবং ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত মহাসমরে অবগাহন করে আমরা স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছি। এটা অনস্বীকার্য যে মুক্তিযুদ্ধের বদৌলতে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন; এই দেশে যিনি জীবনে যা কল্পনা করেননি, তিনি তা হচ্ছেন, হবেন এবং হতেই থাকবেন। এটা হলো স্বাধীনতার প্রাপ্তি।
সুতরাং মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান বিশাল। তাঁদের ত্যাগ-তিতীক্ষা, অঙ্গীকার, দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই বাংলাদেশের বিজয়, বাংলাদেশের অস্তিত্ব। অথচ একটা দুঃখ রয়ে গেছে, বাংলাদেশের সংবিধানের যে প্রিয়েম্বল বা প্রস্তাবনা। যেকোনো বড় গ্রন্থের একটা প্রিফেস বা মুখবন্ধ থাকে; সেটি পুরো বিষয়বস্তুর নির্যাস। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, সংবিধানের সেই প্রস্তাবনার মধ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কথাটা আসেনি। এটা আমাদের জন্য বড় বেদনাদায়ক। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে—কারা স্বাধীন করেছে—জনগণের সহযোগিতা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা। সুতরাং এখানে জনগণের পরেই আসে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ, সেই শব্দ দুটিই আসেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়েছে। এখন অন্তত এই শব্দ দুটোকে অন্তর্ভুক্ত করে মহিমান্বিত করা দরকার। ২০১৭ সালে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাধ্যমে আমরা প্রথম এই দাবি তুলেছি। সভা, সেমিনার, পদযাত্রা করেছি; প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি।
আরেকটি দাবি আমরা করে আসছি। অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। অমুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাবের মাধ্যমে আমাদের মান-সম্মান জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে।
সরকারের কাছে আমাদের এই দুটি দাবি, সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে হবে। এটা নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি। ফলে আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল কিছু যাচাই-বাছাই করছে। কিন্তু সেটার গতি বাড়ানো দরকার।
এ ক্ষেত্রে আমরা দুটি ধারণা দিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধা কারা তার একটা সংজ্ঞা থাকতে হবে। সেটা কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের আগস্টে দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সেই, যিনি একটি সংঘবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনীর অধীনে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।’ ইংরেজিতে কথাটা এসেছে এভাবে, ‘ফ্রিডম ফাইটারস মিন অ্যানি পারসন হু হ্যাভ সার্ভড অ্যাজ এ মেম্বার অব অ্যানি ফোর্স এনগেজড ইন দ্য ওয়ার অব লিবারেশন।’ তাহলে মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে তিনটি জিনিস থাকতে হবে। একটা হলো প্রশিক্ষণ, দ্বিতীয়টা হলো অস্ত্র আর তৃতীয়টা হলো যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞা অনুযায়ী এটাই দাঁড়ায়।
আমি যেমন একটা গ্রুপ কমান্ডার ছিলাম। আমার গ্রুপে ছিলেন ২৫ জন। এ রকম আরও যাঁরা আছেন, তাঁদের যদি বলা হয়—তোমরা তালিকা দাও; তাহলে অনায়াসে তালিকাটা চলে আসত। বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞাকে সামনে রেখে একটি উচ্চতর বিচার বিভাগীয় কমিশন হতে পারে।
আরেকটা ভিন্ন প্রসঙ্গ বলা জরুরি, সরকারের পূর্ণাঙ্গ একটা মন্ত্রণালয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এখানে একজন মন্ত্রী আছেন, সচিব আছেন, অতিরিক্ত সচিব আছেন, দুজন যুগ্ম সচিব আছেন, কয়েকজন উপসচিব আছেন, সহকারী সচিব আছেন। সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের যেমন উপজেলা ও জেলায় কার্যালয় আছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যালয় উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে নেই কেন?
এ জন্য সম্প্রতি সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের যেমন থানাভিত্তিক, উপজেলাভিত্তিক কার্যালয় রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়েরও কার্যালয় স্থাপন করা হোক। আলাদা ঘরও ভাড়া করতে হবে না। মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স যেটা বানানো হচ্ছে, সেখানেই একটি-দুটি কক্ষ ছেড়ে দিলে সুন্দরমতো কার্যক্রম চালানো যায়।
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা যেন না খেয়ে দিন পার না করেন। তাঁদের সন্তানদের যেন চাকরি হয়। তাঁদের স্ত্রীদের যেন ভাত-কাপড়ের অভাব না হয়। এগুলো নিশ্চিত করতে হবে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান যদি বলতেই হয় তবে এর আইনগত ভিত্তি নির্মাণ করতে হবে। সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
পরিশেষে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার রক্তিম শুভেচ্ছা জানাতে চাই। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানসহ শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক, গ্রন্থপ্রণেতা ও চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ