রনিল বিক্রমাসিংহে কি পারবেন?
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সব হিসেব-নিকেশ পাল্টে নির্বাচিত হয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়া দেশকে টেনে তুলতে পার্লামেন্টে আইনপ্রণেতাদের ২২৫ ভোটের মধ্যে ১৩৪ ভোট পেয়ে জিতলেন রনিল। স্পিকারসহ ২২৩ এমপি ভোট দিয়েছেন, ভোটদানে বিরত ছিলেন ২ এমপি এবং বাতিল হয় ৪ ভোট।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে জয়লাভ করবে, তা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অনেকটা নাটকীয়ভাবে সাজিদ প্রেমাদাসার প্রার্থিতা প্রত্যাহারে সবার মনেই প্রশ্ন ছিল, কে হতে যাচ্ছেন গোটাবায়ার উত্তরসূরী? অবশেষে বিক্রমাসিংহে তাঁর অবস্থান ধরে রাখলেন।
ক্ষমতাসীন পার্টির মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন
শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন পার্টির মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন লক্ষ করা যাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী তিনজনের একজন রনিল বিক্রমাসিংহে, যিনি শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ক্ষমতাসীন দলের নন, ইউএনপি পার্টির প্রতিনিধি। তাঁকে সমর্থন করা নিয়ে দল বিভাজিত হয়। একমাত্র শাসক দলের নিরঙ্কুশ সমর্থনই তাঁকে জয় এনে দিতে পারত; কেননা পার্লামেন্টে তিনিই তার দলের একমাত্র সদস্য। দেখা গেলো তিনি শাসকদলের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছেন। শাসকদলের মধ্যে যাঁরা পার্লামেন্ট মেম্বার তাঁদের দলনেতা দিনেশ গুনাবর্ধনে তাঁকে সমর্থন দেন এবং পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের আত্মীয়-স্বজনের প্রত্যক্ষ সমর্থনে তিনি টিকে গেলেন। কিন্তু শাসকদলের চেয়ারম্যান জি এল পেইরি তাঁর বিরোধী; তিনি চেয়েছিলেন আলাহা পেরুনুমাকে নির্বাচিত করতে। তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বটে তবে জনমত ও অন্যান্য কারণে শাসকদল ভেঙে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাজিথ-পেরুনুমা-পেইরি-দেশনায়েক সরকারবিরোধী নতুন জোট গঠন করলে বিক্রমাসিংহের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
রনিল বিক্রমাসিংহের সীমিত আসন
বর্তমান পার্লামেন্টে রনিল বিক্রমাসিংহের আসন সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি শাসকদলের ১৩৩টি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেন। শ্রীলঙ্কার সংকটের মধ্যে গোটাবায়া রাজাপাকসেই কিন্তু তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দায়িত্বে নিয়ে আসেন। ফলে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন। এখন তিনি যদি সাজিথ এবং পেরুনুমাকে আস্থায় নিয়ে আসতে ব্যর্থ হন, তাহলে সরকার চালানো কঠিন হবে; কেননা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের পার্লামেন্ট মেম্বারদের হাত করেছেন। শ্রীলঙ্কার বর্তমান নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এসব গোপন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা কঠিন। তিনি দলীয় প্রেসিডেন্ট না হওয়ায় মাত্র ২২ জন পার্লামেন্ট মেম্বার তাঁর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলেই তিনি পার্লামেন্টে আস্থা হারাবেন এবং তাঁর পতন ঘটবে। এ মুহূর্তে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে আছে ৯১ ভোট। সুতরাং রনিল বিক্রমাসিংহের নিজ দলীয় আসন শূন্যতা তাঁর জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে বর্তমান রুলিং পার্টির যোগাযোগ
রনিল বিক্রমাসিংহের বিজয়ের মূল কারণ বর্তমান রুলিং পার্টির পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের পরিবারবর্গের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এই নির্বাচনে এটি তাঁর জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিলেও এ কারণেই দেশটির বিক্ষোভকারীরা তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে ক্ষমতাচ্যুত রাজাপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় অনেক সাধারণ শ্রীলঙ্কান বিক্রমাসিংহের বিরোধিতা করে আসছে। আন্দোলনরত সাধারণ জনগণের এই রূপ বিরোধিতার মুখে শুধু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জোরে টিকে থাকা কঠিন বৈকি।
পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে, পপুলার ভোটে নয়
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে, পপুলার ভোটে নয়। পপুলার ভোটে নির্বাচন হলে এই মুহূর্তে জনগণের যে মনোভাব রয়েছে সেটার প্রতিফলন ঘটতে পারত, কিন্তু সেটা তো ঘটেনি। ফলে জনগণ তাঁকে কীভাবে, কতটা বা কতক্ষণ মেনে নেবে, সেটাই দেখার বিষয়। ১৯৭৮ সালে প্রথম এবং এরপর ১৯৯৩ সালে এই রকম অভ্যন্তরীণ ভোটের নির্বাচন হয়েছিল। অবশিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করার জন্য পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া, সেখানে জনগণের মতের প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে। যদি জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটত, তাহলে পপুলার ভোটে আলহা পেরুমা বেরিয়ে আসতে পারতেন সহজেই; কারণ, তাঁর পক্ষে পপুলার জনমত রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর সমর্থনেই বিরোধী দলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। খুব সম্ভবত তাঁদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো বোঝাপড়া হয়েছে যে, আলহা পেরুনুমা যদি জয়লাভ করেন তাহলে সাজিথ প্রেমাদাসাকে প্রধানমন্ত্রী বানাবেন। কিন্তু শাসকদলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্ট মেম্বারদের কারণে তা হলো না। এখন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
কী ঘটতে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায়
রনিল বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন জনমতের বিরোধিতা সত্ত্বেও। এটি সম্ভব হয়েছে মূলত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটাতে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়নি কিংবা যায়নি মূলত অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাবে। এখন প্রধান বিরোধীদলের নেতৃত্বে থাকা সাজিথ প্রেমাদাসার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। দেশে জরুরি অবস্থা চলছে, তবে এটি তেমন কার্যকর নয়, কেননা জনগণ রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে। সাজিথ ও পেরুনুমা যদি পার্লামেন্ট বর্জন করে রাজপথকেই বেছে নেন, তবে রনিল বিক্রমাসিংহের জন্য সরকার পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে।
তবে রনিল বিক্রমাসিংহের উত্থান প্রমাণ করে গোটাবায়ার পরিবারতন্ত্রের অবসান হলেও রাজাপাকসে প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীতন্ত্রের শক্তি এখনও অটুট আছে। সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের ওপর তাঁদের প্রভাব যথেষ্টই রয়েছে। ফলে অনিশ্চয়তা রয়েই গেল। বল আসলে এখন সাজিথ-পেরুনুমার কোর্টে। রনিল বিক্রমাসিংহে তা কীভাবে মোকাবিলা করেন, তা-ই দেখার বিষয়।
লেখক : সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়