লিজিংয়ের কাহিনি

Looks like you've blocked notifications!

কয়েক দিন আগে পোস্টার-ফেস্টুন হাতে পিপলস লিজিং ডিপোজিটরস ফোরামের সদস্যরা মতিঝিলে সিটি সেন্টারের সামনে হাজির হয়েছিলেন।  মানুষগুলো এই নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রেখে সব খুইয়েছেন।

এমন নয় যে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি কোনো বেআইনি কোম্পানি ছিল বা ডেসটিনির মতো এমএলএম বাণিজ্য করত। সরকার অনুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল। বিনিয়োগের জায়গা নেই, তাই মানুষ কিছুটা বেশি অর্থের মোহে, কিছুটা এই কোম্পানির সেলস টিমের কর্মীদের চাপাচাপিতে টাকা রেখেছিল। এর অবসায়ন হতে পারে, সেটা জানা থাকলে কেউই সেখানে নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা রাখত না। অথচ তাদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকারসহ সব মহলই কেমন যেন উদাসীন।

আমরা জানি, পিপলস লিজিংয়ের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর আগে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ ও দায়দেনা নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। আর ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর গ্রাহকদের অর্থ আনুপাতিক হারে পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ জন্য গত সেপ্টেম্বর থেকে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস নামক একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পিপলস লিজিংয়ের নিরীক্ষা কার্যক্রম গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা করেনি একনাবিন।

২০১৯ সালের ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের জন্য আবেদন করলে গত ২৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং থেকে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে বিধিনিষেধ দেয়। এতে পিপলসের কাছে ছয় হাজার বিনিয়োগকারী ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত রাখা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এই টাকা আমানতকারীরা আদৌ ফেরত পাবেন কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ দুই হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। আমানতের বিপরীতে সম্পদের পরিমাণ তিন হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। আমানতের মধ্যে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। বাকি ৭০০ কোটি টাকা ছয় হাজার ব্যক্তি-শ্রেণির আমানতকারীর। এ ছাড়া পিপলস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা ঋণ পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে ৭৪৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। এটি মোট ঋণের ৬৬.১৪ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বড় অংশই নিয়েছেন কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা।

সমস্যাটি পুরোনো, অথচ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারছি না আমরা। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ মনে রাখে না কিছু। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের শ্রেণিভুক্ত যারা, তারা লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির শিকার, কাজ পাচ্ছে না বহু পরিবারের ছেলেমেয়ে, সংসার চালানো প্রায় সাধ্যের বাইরে। এ অবস্থায় অনেককেই বেশি লাভের আশায় শিকারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, এই মানুষগুলোর টাকা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করে আজ লাপাত্তা যে পরিচালকেরা, এর দায় কি কেবল মানুষগুলোর? অভিভাবক হিসেবে কী দায়িত্ব পালন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক?

ব্যাংক ও আর্থিক খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে শৈথিল্য ও  প্রশাসনিক বিচ্যুতির কারণেই কিছু কুচক্রী বিবেকহীন অসাধু ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করেছে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ এভাবে নয়ছয় করতে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তাগিরি করার একচ্ছত্র অধিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগের। যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা স্বাভাবিক ব্যাংকিং প্রথার বাইরে বেশি সুদ পাচ্ছিলেন।

আমাদের মনে আছে, নব্বই দশকে ন্যাশনাল ক্রেডিট লিমিটেড ও বাংলাদেশ কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের এই পরিণতি হয়েছিল। যাঁরা টাকা ঢেলেছিলেন, তাঁদের বড় একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। কিন্তু সরকারের তৎপরতায় প্রশাসক বসিয়ে টাকা উদ্ধার করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া গিয়েছিল। সেই দুটি প্রতিষ্ঠান পরে ব্যাংকে রূপান্তর হয়েছিল।

তখন যদি সরকার এমন ব্যবস্থা নিতে পারে, এখনো নিশ্চয়ই পারবে। প্রয়োজন উদ্যোগ আর উদ্যমের। পিপলস বা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং যেভাবে ব্যবসা করেছে, তার দিকে যথাসময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট নানা দপ্তরের নজরদারি থাকলে এটি হতে পারত না। সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে প্রতারণা করেছে এর পরিচালকেরা। পিপলস লিজিংয়ের বিতরণ করা ঋণের একটা বড় অংশই পরিচালকদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানিতে চলে গেছে। পরিচালকেরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করেননি। এত কিছু করল পরিচালকেরা, কেউ দেখল না? আড়ালে-অগোচরে একটি প্রতিষ্ঠান এত ক্ষয়ে যায় কী করে?

ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের দুর্বলতা নিয়ে অনেক কথাই হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটু নড়েচড়ে বসুক। পিপলস লিজিংয়ের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বেশি ঝুঁকিতে থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানের দুঃখজনক পরিণতি ঠেকানোর ব্যবস্থা হোক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রয়োজনে সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আস্থার সংকট দূর করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনোভাবেই হোক, পিপলস লিজিংয়ে টাকা রেখে ক্ষতির শিকার মানুষগুলোর টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সচেতন থাকতে হবে যেন আর কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিণতি এর মতো না হয়।

যারা এর জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। যারা সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে নিজেদের বিত্তবান করেছে এবং করছে, তাদের কোনো ক্ষমা নেই। তারা যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, তাদের প্রতি নির্মম হওয়াই কর্তব্য ও দায়িত্ব।

লেখক : সাংবাদিক