শিক্ষিত বেকার
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক কিছু গবেষণার ফল আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। সর্বশেষ এসেছে বেকারত্ব নিয়ে। প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় উঠে এসেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যেমন বলা হলো শিক্ষিতদের (এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) সনদপ্রাপ্তদের এক-তৃতীয়াংশই বেকার। এঁদের মধ্যে আবার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সনদপ্রাপ্তরা বেশি বেকার। উচ্চশিক্ষায় যাঁরা প্রথম শ্রেণিসহ খুব বেশি ভালো ফল করছেন, তাঁদের প্রায় ৩৪ শতাংশ বেকার।
বিআইডিএস সরকারি প্রতিষ্ঠান। তার গবেষণার মূল্য এবং গ্রহণযোগ্যতা অন্য যেকোনো সংস্থার চেয়ে বেশি। সেই সংস্থা যখন এমন তথ্য দেয়, তখন তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয়। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার সাধারণত শিক্ষিতদের মধ্যেই বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। শিক্ষিতদের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ।
এখানেই শিক্ষা আর কাজের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থনীতির আলোচনায় কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে যে আলোচনা হয়, সেসবে নীতিনির্ধারকদের দিক থেকে যতটা প্রতিশ্রুতি থাকে, ততটা থাকে না সমাধানের ইঙ্গিত। সম্পদ আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আসল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ এখন উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ। মানুষের মাথাপিছু আয়ও বেশি। সেই বাস্তবতায় কর্মসংস্থানে সাফল্যই প্রত্যাশিত। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি পেতে তরুণ সমাজের মধ্যে আকাঙ্ক্ষাই কেবল আমরা দেখে চলেছি। অল্পসংখ্যক সরকারি পদে প্রচুর আবেদন জমা পড়ে। এক দৃষ্টিতে এটি যেমন বেকার সমস্যার একটা চিত্র তুলে ধরে, অন্যদিকে এটাও বলে দেয়, মানুষ একটা পছন্দসই কাজ চায়।
সব দেশেই বেকারত্ব আছে, যেমন আমাদের আছে। বেকারত্ব কমানোর সরকারি প্রচেষ্টা থাকবে, সেটাও ঠিক। কিন্তু বিআইডিএসের গবেষণা-ফল বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশে এখন শিক্ষার সঙ্গে চাকরি বা কর্মসংস্থানের সম্পর্কগত ধারণা বদলে যাচ্ছে। শিক্ষিত হলেই কাজ মিলবে, এমন ধারণা আর থাকছে না। একাডেমিক জীবনে ভালো ফল করলেই ক্যারিয়ার-গ্রাফ ভালো হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে যে বিষয়ে পড়ছে, সে বিষয়ে কাজ পাচ্ছে না বা সেই ক্যারিয়ার তার কাছে আকর্ষণীয় লাগছে না। তাই প্রকৌশলী বা চিকিৎসক বিসিএস দিয়ে যাচ্ছেন পররাষ্ট্র দপ্তরে, প্রশাসনিক বা পুলিশ ক্যাডারে। প্রাণিবিজ্ঞানে পড়ালেখা করে কাজ করছে ব্যাংকে বা বিমা খাতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে কর্মের কোনো সাযুজ্য নেই। অথচ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই এই সাযুজ্য, উপযুক্ত সম্মান এবং যোগ্যতা অনুসারে অর্থ উপার্জন নিশ্চিত করা। কর্মসংস্থানের জন্য দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যশাস্ত্রের জয়জয়কার। প্রচুর ছেলেমেয়ে বিবিএ আর এমবিএ করে বের হচ্ছে প্রতিবছর। তাদের প্রায় সবাই চায় চাকরি। আত্মকর্মসংস্থান, অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যে ধরনের ব্যক্তিগত অবকাঠামো প্রয়োজন, সেখানেও সমস্যা আছে।
শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা এক বড় অস্বস্তি। গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে গিয়ে বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ বলেছেন, উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশে সাধারণত শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের সমস্যা থাকে। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, শিক্ষিতদের বড় একটা অংশ যদি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে, তাহলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এত রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক বিনিয়োগের পর একটি ছেলে বা মেয়ে বেকার থাকলে তা শুধু কষ্টদায়ক নয়, বরং বলতে হবে সম্পদের অপচয়। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কর্মসংস্থানে গ্রাম-শহরের পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। বেতনভিত্তিক চাকরিতে গ্রামের তুলনায় শহরে কাজের সুযোগ বেশি। এর মধ্যে মেট্রোপলিটন শহর এগিয়ে। তবে আত্মকর্মসংস্থানে শহরের তুলনায় গ্রাম এগিয়ে। গ্রামে বেকারত্বের হার বেশি।
এত এত উচ্চশিক্ষিত প্রতিবছর সৃষ্টি করে উপকার কী হচ্ছে, সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠতে পারে। আমাদের এত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকার পরও আমাদের করপোরেট-জগতে বিপুল বিদেশিকে ডেকে আনতে হচ্ছে উচ্চ বেতনে। এ বিষয়টা ভাবা দরকার, কেন এমন হচ্ছে সেই কারণ খুঁজে বের করা দরকার।
আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখছি, গরিবেরা বেকার থাকে না। দরিদ্রদের মধ্যে বেকার কম। বেকার সমস্যা বলে সচরাচর যাকে আমরা চিনি, তা আসলে যাঁরা শিক্ষিত এবং তাঁরাই আসলে কাজ পান না। বড়লোকদের বেকার হওয়ার সুযোগই নেই। ভাবনা মধ্যবিত্তকে নিয়ে, যাদের কাজের সুযোগ প্রসারিত হচ্ছে না। কারিগরি বিদ্যায় দক্ষ একজন বড় বেতনের কাজ পায়, তার কাজের অভাবও হয় না; কিন্তু তার কোনো সামাজিক মর্যাদা সৃষ্টি হয় না। আর এভাবেই শিক্ষিত বেকার তৈরি হয়। শিক্ষিত বিশাল এক জনগোষ্ঠীর অকারণ অযোগ্য উচ্চাশা উচ্চারিত আকাশে-বাতাসে।
এত মানুষ, অথচ উদ্যোক্তারা বলেন, তাঁরা চাকরিপ্রার্থী লাখ লাখ পেলেও সত্যিকারের কাজের লোক পান না। ভালোভাবে বুঝতে হবে কেন বিভিন্ন ধরনের কাজে শ্রমের বাজারে চাহিদা আর জোগানে মিল থাকছে না। পরিকল্পনায় যাঁরা আছেন, তাঁরা শিক্ষা নিয়ে ভাবুন, ফলিত অর্থনীতি নিয়ে ভেবে ঠিক করুন দেশে শিক্ষিত বেকারের জোগান বাড়বে, নাকি এমন শিক্ষাব্যবস্থা হবে যেখান থেকে সত্যিকারের কর্মীবাহিনী সৃষ্টি হবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা