সংগীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খান : প্রজন্মের জীবনবোধের প্রেরণা ও সুরের মূর্ছনা

Looks like you've blocked notifications!

লাজুক লাজুক শিশু মোবারকের হৃদয়ে দোলা দিত সপ্তসুরের মোহনা। বেহালায় হাতেখড়ি। হারমোনিয়ামে রিমঝিম সুর। সুরবাহারে বেজে উঠত ঝংকার। বাড়িতে নিজস্ব কারখানায় বাবার হাতে তৈরি পাশ্চাত্য চেলো যন্ত্রের অনুকরণে বাদ্যযন্ত্র মন্দ্রনাদ থেকেও সুর উঠত। আবার কিছু দিন চলল সারিন্দ্রা বাদ্যযন্ত্রের উন্নত নতুন সংস্করণ চন্দ্রসারং। তারপর চলল তবলা বাঁয়া। শিশু মোবারককে যেমন দেখা গেছে অনুষ্ঠানে গান গাইতে, তেমনি দেখা গেছে তবলা সংগতে। তবে সকল বাদ্যযন্ত্রের মধ্য থেকে তাঁর মনভ্রমরা ধরে রাখল সুরবাহার, শেষ দিনগুলো পর্যন্ত।

শিশু মোবারক যেমন পড়াশোনায় মেধাবী, তেমনি খেলোয়াড় হিসেবেও হয়ে উঠল পারদর্শী। লেখার সূত্রপাত চাচা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জীবনী নিয়ে যা প্রকাশ পায় স্কুল মাগাজিনে। বলছিলাম, উপমহাদেশের প্রায় দুশো বছরের সেনিয়া মাইহার ঘরানার ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রসংগীত পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের কথা। হ্যাঁ, তিনি কিংবদন্তি মোবারক হোসেন খান। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ও মা উমার-উন-নেসার কোলজুড়ে প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা হয়ে ধরায় এসেছিলেন ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেই জ্বলজ্বলে শিখার ছোঁয়া পেয়েছিল সুরের ভুবন, সাহিত্যাঙ্গন আর বিদগ্ধ সমাজ। তা আজও দীপ্যমান।

শিশু মোবারকের জন্মের কিছু পরে বাবা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেব চলে যান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে বাদ্যযন্ত্র বিভাগের প্রধান হিসেবে শান্তিনিকেতনে। পরে ফিরে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজ গ্রামে। বাড়িতেই ছিল বাদ্যযন্ত্র নির্মাণের কারখানা। বাড়ির শিশু সদস্যদের বাজনায় তালিম দিতেন তিনি নিজে। বিচক্ষণ বাবা অনুধাবন করেছিলেন শিশু মোবারক পড়াশোনায় চৌকস। তাই তাঁকে পড়াশোনাতেই অধিক প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোবারক হোসেন খান ইতিহাসে শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৬২ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বেতারকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজীয়তা দেখা দিলে তিনি তাঁর সমস্ত মেধা মনন নিয়ে বেতার পুনর্গঠনের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করেন। রেডিও পাকিস্তানের পরিবর্তে হলো বাংলাদেশ বেতার। একক প্রচেষ্টায় বেতার অধিদপ্তরগুলো সংগঠিত করেন। বেতার কার্যক্রমগুলোর সাথে যথাসম্ভব মিল রেখে ইংরেজি নামের বদলে বাংলা নাম দেন। তার মধ্যে একটি হলো ‘বাণিজ্যিক কার্যক্রম’। বাণিজ্যিক কার্যক্রমে পদায়ন হয় দু’বার। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পরিচালক হিসেবেও ছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর স্বামীহারা কিছু বিধবা মহিলা আসেন তাঁর সাথে দেখা করতে কর্মসংস্থানের আশায়। নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দুর্দশাগ্রস্ত মহিলাদের সেই আশা রক্ষার্থে  তৎকালীন বেতার  মহাপরিচালককে বুঝিয়ে অনুমোদন করে দিয়েছিলেন। টানা তিরিশ বছর বেতারের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন সম্মানজনক পদে ছিলেন। আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে ছিলেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। পদে থাকাকারে যথাসাধ্য বহু মানুষের কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন। তবে পদাধিকার বলে কখনো ব্যক্তিগত সুযোগ নেননি। অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। বেতার কর্মজীবন শেষ হওয়ার পর পরই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন চার বছর বছর এবং পরবর্তী চার বছর নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে  নিয়মিতভাবে যুক্ত ছিলেন। সংগীত বিভাগের বহিঃপরীক্ষক হিসেবে বহু থিসিস দেখেছেন। ভাইভা বোর্ডের সদস্য এবং সিলেবাস কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষকদের পদোন্নতি কমিটিতে সদস্য হিসেবে ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। তিনি নির্ভীক ছিলেন ও সততাকে ধরে রেখেছিলেন আজীবন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগের প্রতি আশা ব্যক্ত করেন তাঁর একটি লেখায়—‘প্রকৃত সংগীত চর্চার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত সাংগীতিক ঐতিহ্যকে লালন ও বিকাশের লক্ষ্যে আমাদের সকল শক্তি, সামর্থ্য ও সম্পদকে নিবেদন এবং আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতার প্রতি আজ আমাদের চিন্তা করতে হবে এবং উদ্যোগ নিতে হবে। সংগীত বিভাগ এ বিষয়ে অবদান রাখবে আশা করি।’

সাহিত্য পূজারী মোবারক হোসেন খানের রক্তে বহমান পূর্বপুরুষের সুর-সংগীত স্রোতধারা। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন সংগীত ভুবনেরই এক উজ্জ্বল তারকা ষাট দশকের শীর্ষস্থানীয় কণ্ঠশিল্পী ফওজিয়া ইয়াসমীনের সাথে। সংগীতাঙ্গনে যখন বৈরী সময় চলছে, তিনি সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ করলেন তাঁর ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবারের ইতিহাস। সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টি করলেন সংগীত বিষয়কে যুক্ত করে। একের পর এক তত্ত্বীয়, ব্যবহারিক, স্বরলিপি, বাদ্যযন্ত্র ও সুর সংগীত স্রষ্টাদের নিয়ে রচনা করেছেন মোট ৬৬টি মূল্যবান শুদ্ধ সংগীতবিষয়ক গ্রন্থ। তার মধ্যে বড়দের জন্য অর্ধশত এবং ছোটদের জন্য ষোলটি গ্রন্থ। সংগীত বিষয়ক খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে এত রকম এত সংখ্যক সংগীতের ওপর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ আর কেউ রচনা করতে পারেননি। বাংলায় যেমন তিনি রচনা করেছেন, তেমনি ইংরেজি অনুবাদও করেছেন বিশ্বের সকল ভাষাভাষীদের জন্য। বিশ্বের দরবারে তাই তো তিনি বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর এই গ্রন্থগুলো এ দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে যেমন পড়ানো হয়, তেমনি সমাদৃত বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। সেখানেও সংগীত বিভাগে রেফারেন্স হিসেবে পড়ানো হয়।

সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তাঁর ঐকান্তিক দায়বদ্ধতা। তিনি অনুবাদ করতেন আগ্রহ ভরে এবং লেখার জগতে শেষ পর্যন্ত অনুবাদ করে গেছেন। অনুবাদক ছাড়াও বহুমুখী গুণের আধার তিনি। একাধারে শিশুসাহিত্যিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার, কলাম লেখক, সম্পাদক, সংগীতজ্ঞ এবং সফল আমলা। সংগীত, সাহিত্য এবং পেশাগত কর্মের প্রতিটি শাখায় সুস্থধারার চর্চার নিমিত্তে নিরলস বিচরণ করেছেন, রেখে গেছেন অসামান্য অবদান।

শিশুদের জানার জন্য যখন যা যা প্রয়োজন মনে করেছেন তাই নিয়ে বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছেন এবং রচনা উপহার দিয়েছেন। তাঁর শব্দচয়ন তাঁর নিজের মতোই সহজ-সরল, প্রাঞ্জল। কৃত্রিমতার রেনু নেই। তাঁর রচনায় ছোটদের জন্য সুর-সংগীত, ধর্মীয়, হাদিস, দেশের কথা, বিজ্ঞান বিষয়ক, মুক্তিযুদ্ধের কথা, রূপকথা, অ্যাডভেঞ্চার, শিশুর কথা বলার বিবর্তন, দেশ-বিদেশের গল্পগুলো ইংরেজিতে ও বাংলায় অনুবাদ অর্থাৎ কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। তাঁর আদরের কন্যাসন্তানের যখন আধো বোল ফুটেছে, তখন শিশুর কথা বলার বিবর্তন সংক্রান্ত বই রচনা করলেন, যা ইতিহাসে প্রথম।

গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে যখনই বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন, কাজের পাশাপাশি নানা রকম দেয়াশলাই সংগ্রহ করাও ছিল তাঁর চমৎকার শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি। তাঁর শিশুসুলভ আনন্দময় সত্তার সন্ধান পেতে হলে তাঁর রচিত শিশুতোষ গ্রন্থগুলোই যথেষ্ট। সেখান থেকে সংক্ষেপে কিছুটা তুলে ধরছি। মামার চোখে ভাগনে-ভাগনিরা মণিমানিকের মতো। তিনি লিখেছেন ‘মামাবাড়ি ভারি মজা’। শিশুদের কল্পলোকের জাদুতে নিয়ে গিয়েছেন প্রচুর রূপকথার গল্প গ্রন্থ রচনা করে । তেমনি ‘রূপকের রূপকথা’, ‘রূপকথার পর রূপকথা’। লিখেছেন ‘রাজিতের চন্দ্রাভিযান’। শিশুর কথা বলার বিবর্তন নিয়ে লিখেছেন ‘রিমির কথা বলা’। শিশুদের পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন আফগানিস্তান,পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, নেপালসহ নানা দেশের নানা রকম মজার মজার গল্প  ‘ভিনদেশী রূপকথার গল্প’ গ্রন্থে। ‘শতাব্দীর সেরা সাইন্স ফিকশন’, ‘বিজ্ঞানের রহস্য’ গ্রন্থগুলোতে টেলিভিশন, রেডিও, টেলিফোন, কম্পিউটার, লেজার রশ্মি এসব সম্পর্কে শিশুর জানার কৌতূহল বাড়িয়ে তুলেছেন। ‘শক্তির রাজা সূর্য’ গ্রন্থে সূর্য, জীবাশ্ম, জ্বালানি, পরমাণু, সৌরশক্তি, সবুজ শক্তি, পানি, বায়ু, ভূ-তাপ-বিজ্ঞানের এমন মজার মজার তথ্য তুলে ধরেছেন। ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগানোর প্রয়াসে রচনা করেছেন হাদিসের কাহিনি। ‘মুক্তিযুদ্ধের সেরা গল্প’, ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলন’, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ এসব গ্রন্থে বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের গান, দেশের গান, গণসংগীত, বুদ্ধিজীবী, ভাষাসৈনিক, কণ্ঠসৈনিক, গণসংগীত শিল্পী, মুক্তিযুদ্ধে সংবাদপত্র, চরমপত্র-এ সকল বিষয় তুলে ধরেছেন। রঙিন পাতার রংচঙে ‘সিন্ডারেলা’ গ্রন্থ হাতে পেলে এমন কোনো শিশু নেই যে আকৃষ্ট হবে না । নিজ শেকড় গ্রাম বাংলার প্রাণ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা গল্পগাঁথা কাহিনি, অর্থাৎ দেশের লোকসংস্কৃতিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চেতনায় প্রবাহিত করেছেন দেশজ গল্পের গ্রন্থগুলো রচনা করে। এমন একটি হলো ‘গ্রাম বাংলার সেরা গল্প’। তাঁর সুর-সংগীত বিষয়ক গ্রন্থগুলো শিশুদের সংগীত ভুবনকে করেছে সমৃদ্ধ।

শিশু মনোজগতে তিনি অনায়াসে প্রবেশ করতে পারতেন তাঁর নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শিশুসুলভ স্বচ্ছ মানসিকতার কারণেই। প্রতিদিন তিনি তাঁর শিশু সন্তানদের সময় দিতেন শত ব্যস্ততার মাঝেও। গল্প শোনাতেন। তাঁদের নামে নিত্যনতুন বই লিখতেন। শুধু নিজ শিশুসন্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, সকল শিশুর প্রতি ছিল তাঁর অগাধ স্নেহ-মমতা। সেই সব শিশুর মাঝ থেকে আমিও সৌভাগ্যবান শিশু ছিলাম, যে অল্প দিনের জন্য হলেও তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। সেই শৈশবের আবছা আলোয় স্মৃতিটুকু আজও জোনাকির মতো জ্বলে। তাঁর ভাতিজা প্রখ্যাত সেতার শিল্পী ওস্তাদ হাফিজ খানের কাছে আমার সংগীতের হাতেখড়ি সেই শিশু বয়সে স্কুল জীবনে প্রবেশের পূর্বেই। ১৯৮৮ সালে মোবারক হোসেন খানকে রাজশাহীবাসী পেয়েছিল বেতার কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে। আর আমি পেয়েছিলাম শ্রদ্ধেয় চাচা হিসেবে। শিশুদের তিনি এত ভালোবাসতেন যে, শিশু শিল্পীরা রেকর্ডিং ও রিহার্সেলের দিনগুলোতে বাসা থেকে বেতারে যাতায়াত করতে যেন কষ্ট না পায় সেজন্য নিজে বিনীত অনুরোধ করে ঢাকা থেকে সবুজরঙা একখানা বিশাল গাড়ি আনিয়ে নেন। আমরা শিশুরা মনের আনন্দে সেই গাড়িতে যাতায়াত করতাম। আমরা ছাড়াও সেই গাড়িতে বহু দিন আমার বাবা এবং শ্রদ্ধেয় মোবারক চাচা একসঙ্গে বহিরাঙ্গন অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। আমার বাবা এবং শ্রদ্ধেয় মোবারক চাচার কর্মযোগ ছিল তাই তাঁদের একত্রে অনেক রকম বেতার সংশ্লিষ্ট কর্মপরিকল্পনাও চলত। মজার ব্যাপার, তাঁর বয়োকনিষ্ঠদেরও কাছে টানার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। একদিন বেতার ভবনের চার নম্বর স্টুডিও থেকে হালকা সুর ভেসে আসছে। সুর শুনতে শুনতে আমার বাবার হাত ধরে নীরবে প্রবেশ করি। দেখলাম রুমে একটি মাত্র আলো জ্বলছে, বাকি গুলো নেভানো। হালকা আলোয় গভীর আবেগে চোখ বুঁজে শ্রদ্ধেয় মোবারক চাচা সুরবাহার বাজাচ্ছেন। শিশু এই আমি বড় বড় চোখ মেলে দেখছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘সুর লহরী’ অনুষ্ঠানে এমন বাজনা শুনেছি শুধু সেটুকুই জানি। তখনও বুঝিনি তিনি ‘সুর লহরী’ অনুষ্ঠানেরও শিল্পী। সুর শুনতে শুনতে বাবার হাত ছেড়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম। তাঁর মনোসংযোগ যাতে নষ্ট না হয়, তাই আমার বাবা  ইশারায় আমাকে থামাতে চাইলেন। তবু আমি চলে গেলাম একদম তাঁর কাছে। বাজনা শেষ হলে খানিক থেমে চোখ খুলেই তিনি দেখতে পেলেন আমাকে। আগেই জানতেন আমি আমার বাবার প্রথম কন্যা এবং বেতার এনলিস্টেড শিশুশিল্পী। স্মিত হেসে পাশে বসিয়ে আমার কচি কণ্ঠের ছড়া শুনলেন। আমি নির্দ্বিধায় কবি নজরুলের ‘লিচু চোর’ আবৃত্তি করতে লাগলাম। পুরোটা শুনলেন মাথা নিচু করে। ছড়া শেষে আমার দিকে তাকালেন। আবার সেই স্নিগ্ধ হাসি। এমন টুকরো অনেক স্মৃতি গোছানো আছে মনের মণিকোঠায়। অগাধ জ্ঞানের স্বল্পভাষী বিনয়ী মানুষটিকে প্রায় দেখতাম নিচে তাকিয়ে হেঁটে যেতে। আর সকলের মাথা উঁচু করার মতো এক একটি অবদান রাখতেন। হঠাৎ বেতার করিডোরে চলতে গিয়ে কাছাকাছি এলেই দেখতে পেতাম তাঁর স্নেহসুধা ভরা চোখ, হাসিমাখা মায়াময় মুখ, যা ভোলার নয়! শিশুমনে তখনও বুঝতাম না কী বিশাল বটবৃক্ষের ছোঁয়া পেয়েছি! আজ ইতিহাস অনুসন্ধান করে যতই তাঁকে জানতে চাই ততই প্রশান্তি আর গর্বে মন ভরে যায়!

দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান স্বীকৃত। সুইডিশ এনসাইক্লোপিডিয়ায় তাঁর ‘বাংলাদেশের সংগীত’ শীর্ষক নিবন্ধ এবং লন্ডনের ক্যামব্রিজ থেকে প্রকাশিত ‘হুজ হু ইন দি কমনওয়েলথ’ গ্রন্থে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত। পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি সারা জীবনে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তিনি মোট ১৩৭টি গ্রন্থের রচয়িতা।

সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি হুমায়ুন কবীর স্বর্ণপদক, কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক, নজরুল স্বর্ণপদক, মাওলানা আকরাম খাঁ স্বর্ণপদক, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এ ছাড়া একুশে পদক (১৯৮৬), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৪), গবেষণা সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০০২) লাভ করেছেন। তিনি ইউনেস্কো হেড কোয়ার্টার্স (প্যারিস) কর্তৃক বাংলাদেশের বাউল গানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর পক্ষে অন্যতম প্রধান কনসালটেন্ট হিসেবে গুরত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।

ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি, কানাডা, গণচিন, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর কোরিয়াসহ অসংখ্য দেশ ভ্রমণকারী। অভিজ্ঞতার পূর্ণতায় আর কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন যাঁর, তিনি ছিলেন নিরহঙ্কার। এই শিক্ষা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে মুটে মজুর চাষী ভাইসহ বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মানুষের সান্নিধ্য ও মেলামেশার সুযোগ পাওয়া তাঁর কাছে ছিল আনন্দদায়ক। তিনি তা বিশেষভাবে পেয়েও ছিলেন সুদীর্ঘ তিরিশ বছর কর্মময় বেতার-জীবনে।

বাবার নৈতিকতা আত্মস্থ করেছিলেন মোবারক হোসেন খান। সঙ্গীতজ্ঞ হয়ে নিজেও বাবা হিসেবে সন্তানদের লেখাপড়ার প্রতি অধিক মনোযোগী ছিলেন। আজ তাঁর তিনটি সন্তান দেশে-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত, বিশ্বের দরবারে সূপরিচিত। পেশাগত কর্মের পাশাপাশি তাঁরাও তাঁদের পারিবারিক সুর সংগীতের ঐতিহ্যকে লালন করছেন। তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রখ্যাত সেতার শিল্পী প্রফেসর রীনাত ফওজিয়া তাঁর লেখায় বলেছেন, ‘আমার বাবা কোমলতা আর কঠোরতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। কঠোর ছিলেন আদর্শ ও নৈতিকতায়।’

তিতাস নদীর পাড়ে শহুরে গ্রামীণ ছোঁয়ায় মিশে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া নবীনগরের শিবপুর গ্রাম আলোকিত করে ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি যে শিশুটি  জন্মেছিল, তাঁর জীবনাবসান হয় ২৪ নভেম্বর ২০১৯ সালে। একাশি বছরের পুরোটা সময় বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে সাহিত্য ও সংগীতাঙ্গনকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। মোবারক হোসেন খানের জীবনবোধ বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে শুদ্ধ সংগীতধারা, সুস্থ সাহিত্য চর্চা ও সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের বর্ণিল স্বপ্নময়তা। তাঁর দেখানো আলোকিত স্বপ্নের পথে আমরা মুগ্ধ যাত্রী। আলোকিত হোক উত্তরসূরী, সংগীতাঙ্গন, লেখককুল ও বিদগ্ধ সমাজ। সেই আলোকে বেঁচে থাকবেন তিনি অনন্তর।

তথ্যসূত্র

* উইকিপিডিয়া

* মোবারক হোসেন খানের কন্যা ও পুত্রদ্বয়

রীনাত ফওজিয়া : অধ্যাপক, সরকারি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, ঢাকা; প্রখ্যাত সেতার শিল্পী ও সংগীত গবেষক

ড. তারিফ হায়াত খান : অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটি, টেক্সাস, ইউএসএ; বিশিষ্ট তবলা ও সরোদ শিল্পী

* তানিম হায়াত খান রাজিত : টিচার, অ্যাকাউন্টিং, ফাইন্যান্স, টেফ ডিজিটাল, ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া; বিশিষ্ট সরোদ শিল্পী

* মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন : মোবারক হোসেন খানের সুহৃদ, বিশিষ্ট বেতার ব্যক্তিত্ব ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

* মাসিক পত্রিকা সরগম

* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পঁচিশ বর্ষপূর্তি সংকলন

* বাংলাদেশ বেতার সুবর্ণজয়ন্তী সংকলন

লেখক : প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট, কবি, কলামিস্ট ও বেতার ব্যক্তিত্ব