সেই দম বন্ধ করা ৩ মিনিট

Looks like you've blocked notifications!

তারিখ : ১৬ জুন ২০২১।

বিকেল ৩:৪১ : অপরিচিত মোবাইল কল। ধরা হয়নি।

বিকেল ৩:৪২ : এসএমএস। প্রান্ত, জয়েন্ট নিউজ এডিটর (ফিচার), এনটিভি অনলাইন।

বিকেল ৩:৫১ : দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ফোন করা। কারণ, প্রান্তের সঙ্গে আমার কোনওদিন কথা হয়নি। কয়েক বার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলেন প্রান্ত। পরিচয়ে বললাম, আমি ইমরান বলছি। অপর প্রান্ত থেকে খুবই পরিচিত ভঙ্গিতে প্রান্ত বললেন, এনটিভির ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ৩ জুলাই। এ উপলক্ষে একটা লেখা চাই আপনার। আপনি সাবেক সহকর্মী। স্মৃতিচারণ...

মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। বিনয়ের সঙ্গে জানালাম, আমি লিখতে পারি না। ক্যামেরার পেছনে সবচেয়ে পেছনের সারির লোক আমি। মানে সম্প্রচার বিভাগের লোক। সেকেন্ডের সঙ্গে উল্টো গোনায় (মানে ৫ ৪ ৩ ২ ১ অন-এয়ার) অভ্যস্ত। সহাস্যে প্রান্ত বললেন, এই যে কথাগুলো বললেন, এগুলো লিখে ফেলুন। আরও বিপদ। আকাশে একবার দেখলাম। কালো মেঘের ঘনঘটা। বোঝাতে চেষ্টা করলাম, বুঝলেন না। হেসে বললেন, লিখতে হবেই। কিছুটা দাবি নিয়ে বললেন, লেখাটা ই-মেইলে পাঠিয়ে দেবেন। আমার এসএমএসে ই-মেইল আইডিটা দেওয়া আছে। একদম পাকাপোক্ত হিসাব। পালাবার পথ নেই। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর কথা বললেন। জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেছেন, আপনি পারবেন। সরাসরি না বলতে পারার বদলে বললাম, লিখতে চেষ্টা করব। যদি লিখতে পারি, তবে আগামীকাল জানাব। এরই মধ্যে মাথার মধ্যে পুরোনো স্মৃতিগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। সেইসঙ্গে বর্ষার ঘন কালো মেঘের অঝোর বৃষ্টি। জানালার কাচগুলো ঘোলা হয়ে আছে। আমার এনটিভির স্মৃতির মতোই। হাত দিয়ে কাচ পরিষ্কার করলাম। সব পরিষ্কার, প্রকৃতি ঘন সবুজ রঙে আঁকা। আস্তে আস্তে স্মৃতিগুলো স্পষ্ট হতে লাগল। আমি তৎক্ষণাৎ কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। প্রান্তের কথার জালে পড়ে ‘পালাবি কোথায়’। কত স্মৃতি লিখব। স্মৃতিগুলো একটার সঙ্গে আরেকটার জট লেগে আছে। আবার কোনও কোনও স্মৃতির সাব-প্লটও আছে। প্লটটা লিখব না সাবপ্লটটা?

টুকরো ঘটনা-১

মনে পড়ে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি আমি আর গ্রাফিক্সের রবি বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ইকবাল সেন্টারের ৫-৬ তলার একটা অফিসের উদ্দেশে যাত্রা। অফিসটির নাম বিল্ডট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এখানেই এনটিভির ক্যাম্প অফিস। এখানে সবাই বসে। বিল্ডট্রেড অফিসে ঢুকতেই একটু ধাক্কা ও কিছুটা বিড়ম্বনা। কারণ, অফিসের মধ্যে ঢুকতে জুতা খুলতে হয়। জুতা খুলে অফিসে প্রবেশ। শুচি ভাইয়ের (হাসনাইন খুরশেদ) সঙ্গে আলাচারিতায় বললেন, নতুন করে শুরু করতে হবে (একুশে টেলিভিশনের শুরুর কথা মনে পড়ল)। বললাম, তথাস্তু।

একদিন পর ১১ জানুয়ারি ২০০৩ শুরু হলো আমার এনটিভির যাত্রা। প্রথমে শুরু করলাম অনুষ্ঠানে জেনার ও প্রোগ্রাম লিস্ট তৈরি। কী কী ধরনের অনুষ্ঠান হতে পারে তার লিস্ট, কোন অনুষ্ঠান ইন-হাউস হবে আর কোন অনুষ্ঠান আউটসোর্সিং হবে ইত্যাদি। এর পর শুরু হয় এফপিসি তৈরির কাজ। এর মধ্যে রানা ভাই জয়েন করেন। তাঁকে নিয়ে এফপিসিটা ফাইনাল করা হলো। এফপিসি তৈরির সময়ে আমি আর রানা ভাই লক্ষ রেখেছিলাম, যাতে অনুষ্ঠান রিপিটের সময় ইউকে ও ইউএসএর পিক আওয়ার হয়। এরপর ট্রান্সমিশন শিডিউল তৈরির কাজ শুরু করি। এর মধ্যে নাসিম ভাই জয়েন করেন।

সাবপ্লট : মানিক জয়েন করেই বিয়ের জন্য ছুটি নেয়, যদি পরে বিয়ে করার সময় ছুটি না পাওয়া যায়!

সম্ভবত ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে মোস্তফা কামাল সৈয়দকে (কামাল ভাই) অফিসে দেখি। এরপর খোরশেদ আলম (আলম ভাই) আসলেন। জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে দুটো কার্টন আসে। শুচি ভাই বললেন, এর মধ্যে কিছু ইকুইপমেন্ট আছে। বিল্ডট্রেড অফিসের বোর্ডরুমে কার্টন খোলা হয় দুটি সনি পিডি ১৭০ ক্যামেরা, ট্রাইপড, মাইক্রোফোন, লাইট সেট আর ২০টা টেপ। বুঝে নিলাম সমস্ত জিনিস। পরের দিন নিউমার্কেট থেকে দুইটা রেজিস্ট্রি খাতা (একটা যন্ত্রপাতির জন্য, অপরটা টেপের জন্য), পার্মানেন্ট মার্কার, স্টিকার পেজ, ক্যামেরা পরিষ্কার করার ব্রাশ আর ক্যামেরার জন্য ব্যাগ কিনলাম। যথারীতি জামান ভাই অফিস থেকে টাকাটা দিয়েছিলেন। পরের দিন ক্যামেরা ইউনিট ১ ও ২ নামে দুটো ক্যামেরা ইউনিট তৈরি করা হয়।

সাবপ্লট : এখন মনে পড়ল তখন পর্যন্ত আমি, রানা ভাইসহ কয়েক জন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাইনি। আমাদের অ্যাপয়েনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেলের অধীনে। অফ হোয়াইট কাগজে সোনালি অক্ষরে ইন্টারন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেল লিমিটেড লেখা।

কাজের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয়নি। কারণ, বিল্ডট্রেডের সবাই সহযোগিতা করেছিলেন আর পেছন থেকে চেয়ারম্যান স্যার (জনাব আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী)। আমরা প্রত্যেকে নতুন একটি টেলিভিশন চ্যানেল নিজ হাতে তৈরির স্বপ্ন ও আনন্দে বিভোর।

জানুয়ারি মাসে গ্রাফিক্সের রবি আর হুদা ভাই (মিঠু পরে জয়েন করে) এনটিভির লোগো, স্টেশন আইডি, নিউজ আইডির কাজ শুরু করে। প্রতিদিন একটু একটু করে কাজ হয় আর আমি দেখি কীভাবে আস্তে আস্তে একটা টেলিভিশন চ্যানেল সাদাকালো অক্ষর থেকে জীবন্ত ও রঙিন হয়ে উঠেছে।

টুকরো ঘটনা-২

সময় : জুন-জুলাই ২০০৩।

এত দিনে আমরা কারওয়ান বাজারের বর্তমান অফিসে নিয়মিত অফিস করি। চারদিকে নির্মাণযজ্ঞ। সব বিভাগ কর্মব্যস্ত। কারও দম ফেলার সময় নেই। সম্ভবত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে চেয়ারম্যান স্যার জানালেন আগামী জুলাই মাসের ৩ তারিখে এনটিভির উদ্বোধন হবে এবং সেদিন থেকে কমার্শিয়াল ট্রান্সমিশন শুরু হবে।

এর মধ্যে বেলাল আমানের তত্ত্বাবধানে জুন মাসের শুরুতে টেস্ট ট্রান্সমিশনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। টেস্ট ট্রান্সমিশনের জন্য মানিক (মানিক চৌধুরী) বিভিন্ন অনুষ্ঠান, গান ও ইনফরমেশন কার্ড দিয়ে প্রথম একটা তিন ঘণ্টার ডিভি-ক্যাম টেপ তৈরি করে দেয়। এটাই এনটিভির প্রথম ট্রান্সমিশন টেপ। ওই সপ্তাহের এক বিকেলের পরে চেয়ারম্যান স্যার, তৎকালীন এমডি স্যার (জনাব এনায়েতুর রহমান), শুচি ভাই, কামাল ভাই, বেলালসহ অফিসের কয়েক জনের উপস্থিতিতে খুবই অনাড়ম্বরভাবে টেস্ট ট্রান্সমিশন শুরু হয়। সনি এইচভিআর ১৫০০ ভিটিআর দিয়ে সেই তিন ঘণ্টার টেপটা চালানো হলো। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এনটিভির টেস্ট ট্রান্সমিশনের প্রথম টেপটা চালানোর। এখন যেখানে প্রমো এডিট প্যানেল, সেখানে একটা টেবিলের উপরে ভিটিআর রেখে টেস্ট ট্রান্সমিশন চালানো হয়েছে। ২-৩ দিনের মধ্যে পরবর্তী সময়ে আর্থ স্টেশন থেকে টেস্ট ট্রান্সমিশন শুরু হয়।

টুকরো ঘটনা-৩

খুব তাড়াতাড়িই সবকিছু বদলে যাচ্ছিল। আরও জীবন্ত ও প্রাণময়। সময়ের সাথে পাল্লা। ৩ জুলাই, সন্ধ্যা ৭টা। যেমন করেই হোক তাকে ধরতে হবে। প্রাণপণ চেষ্টা। কোনো ফাঁকফোকর যেন না থাকে। কারণ, প্রত্যেক বিভাগের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ সম্প্রচারের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে। যদি কোনও ভুল হয় তাহলে সবার মেধা, শ্রম, মান-সম্মান মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। একটা কথা আছে— প্রথম দেখায় প্রেম—যদি সম্প্রচারে ভুল হয় তাহলে তো দর্শকের ঘরে ঘরে গিয়ে বলা যাবে না যে এই কারণে ভুল হয়েছে। আর তাতে যদি দর্শকের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আশা করি, সেদিন থেকে দর্শক কখনও এনটিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি, এখনও না।

৩ জুলাই। কাউন্টডাউন শুরু। দিন আসে আর ফুরুৎ করে চলে যায়। ২ জুলাই যথারীতি অফিসে আসি। সবাই মিলে কাজ শুরু করি, কিন্তু কারও কাজ যেন শেষ হয় না। কেমন করে নতুন নতুন কাজের জন্ম হয়। আমরা মানে পিনাকীদা, তারেক, নাসিম ভাই, মানিক, রানা ভাইসহ সবাই একটা উত্তেজনায় ভুগছি। সেইসঙ্গে টেনশন। সেই রাতে আমার আর বাড়ি ফেরা হলো না, সঙ্গে রানা ভাইয়েরও। ৩ জুলাই ভোরে আর্কাইভে (বর্তমানে সাকিব ভাই ও রাসেল ভাই যে রুমে বসেন) দুটো বেটা টেপ মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল সকাল ৮-৯টার দিকে। বাসায় ফিরে আবার অফিসে আসলাম ১১টার দিকে। বর্তমান সাত তলার নিউজ স্টুডিওর পিসিআর-এ অস্থায়ী এমসিআর তৈরি করা হয়। সেদিন টেস্ট ট্রান্সমিশন বন্ধ রাখা হয়েছিল। একটা গ্রাফিক্স কার্ড স্ক্রিনে ফিক্সড করে রাখা হয়েছিল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় জানিয়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হোটেল সোনারগাঁও থেকে সরাসরি সম্প্রচার। সেদিন আমরা সোনারগাঁও হোটেল থেকে অফ-এয়ারে বারকয়েক সিগন্যাল টেস্ট করি। ট্রান্সমিশন শিডিউল অনুযায়ী (রান অর্ডার তৈরি, অনুষ্ঠানের টেপ তৈরি, কমার্শিয়াল টেপ তৈরি) সবই সম্পন্ন হয়েছে। এখন ৭টার অপেক্ষা। ৬টার দিকে অস্থায়ী এমসিআর-এ ভিশন মিক্সিং প্যানেলে পিনাকীদা, আমি ভিটিআর প্যানেলে আর সবুজ ভাই অডিও কনসোল প্যানেলে বসলাম। দম বন্ধ করা অবস্থা। স্টুডিওর পিসিআর-এ সবই দাঁড়িয়ে। মানে যত জন দাঁড়ানো যায়। একেবারে ঠাসা। শুচি ভাই সবাইকে স্টুডিওর পিসিআর থেকে চলে যেতে বললেন। ডালিম ভাই স্ট্যান্ডবাই থাকলেন। যদি কোনো বিপদ হয় তাহলে উনি যাতে স্টুডিও থেকে সরাসরি কথা বলতে পারেন। সেদিন রাতে নিউজও প্রচার করা হয়।

সন্ধ্যা ৬:৫০ মিনিট : সবাই স্ট্যান্ডবাই।

সন্ধ্যা ৬:৫৭ মিনিট : সন্ধ্যা ৭:০০টার তিন মিনিট ব্যাক ক্যালকুলেশন করে টেপ প্লে করলাম। মানে এনটিভি অন-এয়ারে। আমি যথারীতি ৫-৪-৩-২-১-স্টুডিও বলার সাথে সাথে পিনাকীদা সুইচ করে সোনারগাঁও হোটেলের লাইভে চলে গেলেন আর সবুজ ভাই একইসঙ্গে অডিও অন করলেন। সন্ধ্যা ৬:৫৭ থেকে সন্ধ্যা ৭:০০টা, সেই তিন মিনিটের কথা আমার মনে নেই। লোকে বলে পাথর সময়। তিন মিনিটটা হয়তো পাথর সময়। ওই মাহেন্দ্রক্ষণ হঠাৎ করে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে কেমন করে যে চলে গেল সময়ের গহ্বরে। আজও চিন্তা করে ঠাহর পাই না। পরের দিন অর্থাৎ ৪ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাড়ির দিকে রওনা হই। সেদিন আমার কেমন জানি খালি খালি লাগছিল, যেন আমি কিছু হারিয়ে ফেলেছি। বাসায় রেস্ট নিয়ে আবার বিকেলে অফিসে আসি। এনটিভির উদ্বোধনী বিশেষ অনুষ্ঠানমালা টানা ৪৮ ঘণ্টা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এনটিভি আস্তে আস্তে ২৪ ঘণ্টার চ্যানেলে পরিণত হয়। সেই যে এনটিভির ‘সময়ের সাথে আগামীর পথে’ চলা শুরু, এখনও চলছে এবং চলবে। ছোটবেলায় পড়া রূপকথার গল্পের শেষ দৃশ্যের মতো অতঃপর রাজা-রানি (এনটিভি) সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগিল। আমার গল্পটি ফুরাল, নটে গাছটি মুড়াল। স্যার জনাব আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী ও এনটিভি পরিবারের সবাইকে ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা।

লেখক : কনসালট্যান্ট, বেঞ্চমার্ক ব্রডকাস্ট সিস্টেমস (এস) পিটিই লিমিটেড, সিঙ্গাপুর