স্বর্গের উদ্যান ইডেন

Looks like you've blocked notifications!

টুকটাক যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, ইডেন গার্ডেন তাঁদের কাছে অন্যরকম ব্যাপার। যাঁরা ক্রিকেট ভালোবাসেন, ইডেন তাঁদের কাছে স্বপ্নের মতো। আর ক্রিকেট যাঁদের ধর্ম, ইডেন তাঁদের কাছে স্বর্গের উদ্যান। আপনারা যাঁরা টুকটাক আমার লেখা পড়েন, তাঁরা জানেন ক্রিকেট নিয়ে আমার প্রবল আবেগ। একসময় ক্রিকেট শুনতাম রেডিওতে। তারপর খেলা দেখতাম টিভিতে। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আমিও ছিলাম। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেও অনেক ম্যাচ দেখেছি। তবে দেশের বাইরে খেলা দেখার সুযোগ হয়নি কখনো। সরাসরি খেলা না দেখলেও টিভিতে খেলা দেখে আর নানান ইতিহাস পড়ে দুটি মাঠ আমার কল্পনায় অন্যরকম স্থান করে আছে। তার একটি কলকাতার ইডেন গার্ডেন, অন্যটি অবশ্যই লর্ডস। দেশের বাইরে প্রথম খেলার সুযোগ, সেটা আবার ইডেনে, সব যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল ২১ নভেম্বর ইডেনে প্রথম পিঙ্ক টেস্ট দেখব। কিন্তু ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে ড. মোফাকখারুল ইসলামের কাছে গেলাম টিকেটের জন্য। তখনো আমরা হোটেল পাইনি। তিনি খুব ব্যস্ত। বললেন, ‘আমি মাঠে যাচ্ছি, আপনারা যাবেন?’ মাঠ মানে ইডেন গার্ডেন! আমরা তো নাচতেই এসেছি, আমাদের ঢোলের বাড়ি লাগে না। সব লাগেজসহ ইকবাল ভাইয়ের সঙ্গী হলাম। তাঁর সৌজন্যে একদিন আগেই স্বর্গদর্শন হয়ে গেল।

আমরা যখন মাঠে গেলাম, তখন মাঠে দুই দলই প্র্যাকটিস করছিল। ফ্লাডলাইটে ঝলমলে ইডেন, কিন্তু গ্যালারি ফাঁকা। ইডেনের বড়পর্দায় লেখা ছিল—Welcome to Eden gardens, Kolkata. ক্রিকেটারদের প্র্যাকটিস শেষে শুরু হলো পরের দিনে পিঙ্ক টেস্টের উদ্বোধনী মহড়া। সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল। ইকবাল ভাইকে ধন্যবাদ। তার উসকানি না পেলে ইডেনকে এমন একান্তে কাছে পেতাম না।

পরের দিন মাঠে গিয়ে দেখেছি ইডেনের অন্য রূপ। অনেকদিন পর ভারত নামছে ইডেনে। গোলাপি টেস্ট বলে ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারলে গোটা কলকাতাই ইডেনে চলে আসে। তবু সর্বশেষ কবে এমন পূর্ণ গ্যালারিতে টেস্ট হয়েছে বলা মুশকিল। একসময় ইডেনের ধারণক্ষমতা লাখের ঘরে ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে বিশ্বকাপ উপলক্ষে সংস্কারের সময় আসন-সংখ্যা কমে আসে ৬৭ হাজারে। তবু ৬৭ হাজার মানুষ যখন একসঙ্গে চিৎকার করে, সমুদ্রের গর্জনও হার মানে বুঝি। তৃতীয় দিনের শুরুতে আমার সঙ্গী তাপসদার টিকেট আসতে দেরি হচ্ছিল বলে আমরা ‘আসল ইডেন গার্ডেনে’ অপেক্ষা করছিলাম। বাইরে থেকে ইডেনের চিৎকার আরো গগনবিদারী। বিশ্বচরাচর কেঁপে কেঁপে উঠছিল যেন।

আসল ইডেন গার্ডেন শুনে নিশ্চয়ই কেউ কেউ অবাক হয়েছেন। তবে নকল কোনটা? আমি ভেবেছিলাম, ভালোবেসে ক্রিকেট মাঠের নাম গার্ডেন রাখা হয়েছে। কিন্তু কাছে গিয়ে ভুল ভাঙল। যেখানে ক্রিকেট খেলা হয়, সেটি নকল ইডেন গার্ডেন, আর সেটি গড়ে উঠেছে আসল ইডেন গার্ডেনের পেটে। ক্রিকেট মাঠের পাশেই সুরম্য উদ্যান ইডেন গার্ডেন। ১৮৩৬ থেকে ১৮৪২ পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড অকল্যান্ড। তাঁর দুই বোনের সান্ধ্যভ্রমণের জন্য গড়ে তোলা হয় একটি বাগান। প্রথমে এর নাম ছিল ‘অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন’। কিন্তু লর্ড অকল্যান্ডের বোনদের স্মৃতি ধরে রাখতে ১৮৫৬ সালে নাম দেওয়া হয় ইডেন গার্ডেন। ১৮৬৪ সালে বাগানের পাশেই গড়ে ওঠে ক্রিকেট খেলার মাঠ, যা আজকের ইডেন গার্ডেন। একসময় যেটা ছিল ঘন জঙ্গল, এখন সেটাই কলকাতার প্রাণকেন্দ্র; কেউ কেউ বলেন কলকাতার ফুসফুস। ইডেন গার্ডেনসের আশপাশেই গড়ের মাঠ, রেসকোর্স, মোহামেডান ক্লাব, মোহনবাগান ক্লাব, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ফোর্ট উইলিয়াম; একটু দূরেই গঙ্গা।

বলছিলাম নকল ইডেন গার্ডেন, মানে খেলার মাঠের কথা। এখানের পরতে পরতে ইতিহাস খোদাই করা। অনেক ছবি, অনেক নাম, অনেক ইতিহাস। সেদিনের খেলা নয়, আমার কেবলই আজহার, শচীন, লক্ষণ, দ্রাবিড়, কপিল, সেলিম মালিক, শোয়েবদের কথা মনে পড়ছিল। ইডেন গার্ডেনে পিঙ্ক টেস্টে তাঁদের অনেকের সঙ্গে দেখাও হয়েছে।

আসল ইডেন গার্ডেনে ফুল ফোটে নানা বর্ণের। নকল ইডেন গার্ডেনেও ফুল ফোটে, ফোটান ক্রিকেটাররা। চার, ছক্কা, সেঞ্চুরি, উইকেটও তো কখনো কখনো ফুলের মতোই সুন্দর। ইডেন গার্ডেনের অনার্স বোর্ডে এমন অনেক ফুলের নাম, যাঁদের কীর্তিতে আরো সুন্দর হয়েছে ইডেন গার্ডেন। আহা, কবে বাংলাদেশের কারো নাম উঠবে সেই অনার্স বোর্ডে, কবে বাংলাদেশের কেউ ব্যাট-বলে ফুল ফোটাবে ইডেন গার্ডেনে?

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক