পর্যটকের বয়ানে

সেন্ট মার্টিনবাসীর দুঃখগাঁথা

Looks like you've blocked notifications!

টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার পথে যে বিষয়টি বিমোহিত করে সেটা হলো, সিগাল পাখির উড়াউড়ি। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেন্ট মার্টিন যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠেছি মাত্র। তখনো জাহাজ ছাড়েনি। ভেতরে ভিড় থাকায় বাইরে এসে দেখি, অসংখ্য সিগাল পাখি। তাই সিটে আর বসলাম না। ব্যাগটা সিটের ওপর রেখে জাহাজের বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। সিগালের ওড়াউড়ি, চেঁচামেচি সত্যিই যেন এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। বঙ্গোপসাগরের মোহনা হওয়ায় জলরাশির বিশালতা, সঙ্গে  প্রাকৃতিক দৃশ্য তো রয়েছেই। 

দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা নদী-সমুদ্রপথে যাত্রা শেষে কুতুবদিয়া জাহাজ থেকে নামার সময়ই এই ঘোর কাটতে শুরু করে। নাফ নদ আর বঙ্গোপসাগর পার হয়ে সেন্ট মার্টিনে এসে শুরু হয় জাহাজ থেকে নামার অপেক্ষা। জাহাজ থামার প্রায় ১৫ মিনিট পর নামার উদ্যোগ নিলাম। ভিড়ের কারণে বোঝাই যাচ্ছিল নামাটা অতটা সহজ হবে না। কারণ জাহাজ থেকে নামার জন্য একটি মাত্র পথ  সরু কাঠের সিঁড়ি। কেউ সেখানে স্লিপ কাটলে বা অন্য কোনো কারণে পড়ে গেলে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

ভালোভাবে না আটকানো থাকায় মাঝে মাঝে জাহাজটা নড়াচড়া করছিল। ফলে সরু কাঠের সিঁড়িটাও সরে যাচ্ছিল, জাহাজের কর্মীরা প্রাণপণে ঠেকানোর চেষ্টাও করছিল। যাত্রীরাও অনেকটা আতঙ্ক নিয়েই নামছিল। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম নামার জন্য। অপেক্ষারত অবস্থাই পাঁচ-ছয় বছরের এক শিশুকে দেখতে পেলাম, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। অনেকটা আতঙ্কের সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই বাবু, ব্যাগটা তোমার কাছে কে দিয়েছে?’ পাশে থাকা বয়সে একটু বড় আরেকটি ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘সমস্যা নেই, অভ্যাস আছে।’ তখন নিজে নিজেই আক্ষেপ করে অজান্তেই বলে উঠলাম, ‘পেটে ভাত না থাকলে কত কিছুই না অভ্যাস হয়ে যায়!’

দুই.
এই দুই শিশু সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কোনো হত-দরিদ্র পরিবারের। ভেবেছিলাম, এমন করুণ দৃশ্য বোধহয় আর দেখতে হবে না। কিন্তু দ্বীপের ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই ভুল ভাঙতে শুরু করে। এ রকম অসংখ্য ছেলেমেয়ে চোখে পড়তে থাকে। যেসব শিশুর প্রয়োজনীয় কাপড় নেই, চুল দেখে মনে হয় কত কাল যেন তেল-সাবান পড়ে না। স্বাস্থ্যের অবস্থাও ভালো না। স্থানীয় মানুষজনের চোখেমুখে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। বাড়িঘরের অবস্থাও একেবারে নাজেহাল। বেশির ভাগেরই ছন-পাতা-পলিথিন দিয়ে তৈরি ঘরবাড়ি। 
এ পর্যায়ে এসে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে পর্যটকরা থাকে কোথায়? তবে পর্যটকদের জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। থাকার জন্য রয়েছে কটেজ, হোটেল; খাবারের জন্য রেস্টুরেন্ট। এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, স্থানীয়দের যে আর্থিক অবস্থা তাতে অন্তত এটুকু বলা যায় তাদের পক্ষে বহুতল ভবন, রেস্টুরেন্ট দেওয়া সম্ভব নয়। তাই পর্যটকরা সেন্ট মার্টিনে ঘুরতে গেলে যে আয় হয়, তা স্থানীয়দের পকেটে ঢুকে না। যারা ওই সব রেস্টুরেন্ট, হোটেলের মালিক, তারাই সেই সুবিধাটা নিয়ে থাকে। অর্থাৎ বহিরাগত রেস্টুরেন্ট-হোটেল ব্যবসায়ী, শুঁটকি ব্যবসায়ী; স্থানীয় অল্পকিছু মানুষ পর্যটন-অর্থনীতির ফল ভোগ করে। সেন্ট মার্টিনবাসী নয়।

স্থানীয়রা কি তাহলে একেবারেই পর্যটন-অর্থনীতির সুবিধাভোগী নয়? এমন প্রশ্ন উঠলে হয়তো বলতে হবে, সুবিধাভোগী, তবে মাত্রা একটু ভিন্ন। বিষয়টি পরিষ্কার হতে কক্সবাজারের উপজাতি দোকানদারদের প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। কক্সবাজারের অনেক দোকানেই উপজাতি দোকানদার দেখে এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেছিলেম, ‘এই দোকানের মালিক তিনি কি না?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘তিনি সেলসম্যান, মালিক বিদেশে থাকেন।’ অর্থাৎ পাবর্ত্য, উপকূলীয় অঞ্চলের ‘আকর্ষণীয় প্রাণী’ উপজাতিদের শো করে দেদার ব্যবসা করে একটা শ্রেণি। অনেকটা একই রকম কথা খাটে, সেন্ট মার্টিনবাসীর ক্ষেত্রেও। সেন্ট মার্টিনবাসী হোটেল-রেস্টুরেন্টের গার্ড, কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী; কিন্তু মালিক-শ্রেণি তারা নয়। উপজাতীদের মতো সেন্ট মার্টিনবাসীরও হয়তো এটুকুই লাভ!  

তিন.
সেন্ট মার্টিনে সাইকেল দিয়ে পুরো দ্বীপটি ঘুরে দেখার একটা চল রয়েছে। সাইকেল ভাড়া করতে গিয়ে সেই একই চিরাচরিত চিত্র। সাইকেলের দোকানের মালিকের হদিস পাওয়া গেল না, যারা কাজ করছে তারা স্থানীয়। তাদের কাছ থেকেই সাইকেল ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেন্ট মার্টিনের শেষ প্রান্তে এসে বাড়ির সঙ্গে লাগানো এক দোকানে চা, হালকা নাশতা করি। লতাপাতা-ছন-পলিথিন দিয়ে তৈরি দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বন্ধু ইব্রাহীম জানতে চেয়ে বলেন, ‘আট বা নয় নম্বর বিপদ সংকেত হলে আপনাদের এই বাড়িঘর থাকে?’ জবাবে দোকানদার বলেন, ‘আমরাও তো মানুষ। এখানে থাকতে পারি বলেই তো থাকি।’ তারা মানুষ, তাদের আত্মসম্মানবোধ আছে, আছে প্রকৃতির সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই। তার চোখ-মুখ যেন এ কথাগুলোই বলতে চাইছিল। 

পাশেই সমুদ্র তীরের কেয়াগাছ দেখিয়ে ওই দোকানদার বলেন, ‘ওই পর্যন্ত পানি ওঠে।’ এক শিশুকে কেয়াগাছ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এগুলোর নাম কী? সে বলেছিল, ‘ঠেকাগাছ’। সমুদ্রের হাত থেকে সেন্ট মার্টিনকে যেমন, তেমনই সেন্ট মার্টিনবাসীকেও বাঁচিয়ে রেখেছে বলেই হয়তো এমন নাম সে বলেছিল। 

চার.
কিন্তু সমুদ্র তীরের ওই দোকান থেকে বের হতে না হতেই, আঙিনায় মানুষের মল দেখে শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। আত্মসম্মান থাকলেও তাদের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই, স্বাস্থ্য-সচেতনতা নেই। তাদের জন্য এসবের ব্যবস্থাও হয়তো কেউ কখনো করার চিন্তা-ভাবনা করে না।   

সেন্ট মার্টিনজুড়ে বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে সন্ধ্যা হলে বাতি ঠিকই জ্বলে, জেনারেটর বা অন্য উপায়ে ওই সব হোটেল-রেস্টুরেন্ট-দোকানে। কিন্তু স্থানীয়দের ঘরে আলো জ্বলে না। সেন্ট মার্টিনে ইন্টারনেটের জোড়ালো গতিও মেলে, মেলে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। মোবাইল ফোন ব্যবহার একটু-আধটু ব্যবহার করার সাধ্য থাকলেও ইন্টারনেট ব্যবহারের সাধ্য বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই সেন্ট মার্টিনবাসীর। এ থেকে এটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়, এসব সুযোগ-সুবিধা সেন্ট মার্টিনবাসীর কথা চিন্তা করে নয়! শুধুই ব্যবসার কথা চিন্তা করে, পর্যটন ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে করা। 

অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও রাত কিংবা দিন, যেকোনো সময়ই পর্যটকরা চলাচল করতে পারে নিশ্চিন্তে। অর্থাৎ তাদের ছিনতাই বা অন্য কোনো হয়রানির শিকার হতে হয় না। সেন্ট মার্টিনের যারা হর্তাকর্তা বা নিয়ন্ত্রক তারা ভালো করেই জানে, চুরি-বাটপারি-ছিনতাই এগুলো হলে পর্যটকরা এখানে আসবে না। তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা সবধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই করে রেখেছে পর্যটকদের জন্য। এ থেকে অন্তত এটা বোঝা যায়, হর্তাকর্তারা চাইলে সব জায়গায়ই নিরাপত্তা দিতে পারে, কিন্তু তারা দেয় না। কারণ হয়তো স্বার্থগত পরিপ্রেক্ষিত, পরিস্থিতিটা থাকে ভিন্ন। 

পাঁচ.
সেন্ট মার্টিন যে অপার সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আসে পর্যটক। পর্যটন এলাকা হওয়া অন্য দ্বীপবাসীর মতো তাদের জীবনব্যবস্থা এতটা করুণ হওয়ার কথা ছিল না। অথচ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পর্যটন অর্থনীতি জিম্মি, তাই অধিবাসীরা এর সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। এদিকে রাষ্ট্রেরও তাদের বেঁচে থাকার অধিকারের দিকে তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাই সেন্ট মার্টিন অপার সৌন্দর্য পর্যটকদের মনে হিল্লোলের সৃষ্টি করলেও এর অধিবাসীদের মনে এটা হয়তো কোনো অনুভূতিরই জন্ম দিতে পারে না। অভাব-অনটন আর রূঢ় বাস্তবতার কারণে সেন্ট মার্টিনবাসীর কাছে হয়তো দ্বীপটির সৌন্দর্য নিরর্থক লাগে।

লেখক : প্রতিনিধি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়