অভিমত

জেলা পরিষদ নির্বাচন কি নাসিকের মান রাখবে?

Looks like you've blocked notifications!

আজ ২৮ ডিসেম্বর। আজই বাংলাদেশের ইতিহাসে জেলা পরিষদের সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। আর এ নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, বাংলাদেশের মূলধারা ও পদ্ধতির নির্বাচনী ব্যবস্থার বাইরের বেসিক ডেমোক্রেসির একটি নির্বাচন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে, অর্থাৎ ১৮৮৫ সালে প্রথম জেলা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে কখনোই এটিতে সরাসরি কোনো জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়নি। সে সময় অবশ্য ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো ব্রিটিশ বেসিক ডেমোক্রেটিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলা পরিষদ নামে থাকলেও তাকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

এমনকি বিগত সময়ে সরকার ঘোষিত চারস্তরের স্থানীয় সরকারের মধ্যে গ্রাম সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং সবচেয়ে বড় হলো জেলা পরিষদ থাকলেও সেখানে নির্বাচন দেওয়া হয়নি। সেখানে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর দেশের ৬১টি জেলায় প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদকে কার্যকর করার স্বার্থে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের দিয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জেলা পরিষদ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়।

পরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়। আর বাকি তিনটি পার্বত্য জেলায় আগে থেকেই স্থানীয় সরকার হিসেবে জেলা পরিষদ থাকায় সেগুলোকে এর বাইরে রাখা হয়। কাজেই সেসব ৬১ জেলা পরিষদ প্রশাসকদের মেয়াদ শেষে তাই নতুন নীতিমালার আলোকে ব্রিটিশ ও আমেরিকার আদলে বেসিক ডেমোক্রেসি প্র্যাকটিসের অংশ হিসেবে আজকের নির্বাচন হচ্ছে। আজকের এ নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সরাসরি জনগণের ভোটের অংশগ্রহণ না থাকায় একে যেমন ‘মন্দের ভালো হিসেবে’ এবং ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা’ ইত্যাদি নামে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ভালোভাবে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের একটি ফ্লেভার রয়েছে দেশে। নাসিক নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে যে একটি ভাবমূর্তি সৃষ্টি হলো, এর মধ্যে আজকের এ নির্বাচনটি কি সেই ধারাবাহিকতা হবে, নাকি অন্য কিছু! পর্যবেক্ষকদের কাছে আজকের এ নির্বাচন কিছুটা উত্তাপহীন। কারণ, একদিকে সেখানে সরসরি জনগণের অংশগ্রহণ নেই, অন্যদিকে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই। এখানে জেলা পরিষদ এলাকায় থাকা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের মূল্যবান ভোট দিয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কাউন্সিলর নির্বাচিত করবেন।

সে হিসেবে আয়তন, সংখ্যা ইত্যাদির বিচারে প্রতি জেলায় তিনশ’ থেকে ছয় শতাধিক জনপ্রতিনিধি ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছেন। সে হিসেবে সারা দেশে ৬১ জেলায় মোট ভোটারের সংখ্যা হবে প্রায় ৬৫ হাজারের কাছাকাছি। আর একজন চেয়ারম্যান, ১৫টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৫ জন কাউন্সিলর এবং প্রতি তিন ওয়ার্ডের জন্য একজন করে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরের সমন্বয়ে ২১ সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ হচ্ছে এটি। এ নির্বাচনটি প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়নে প্রার্থিতা দিলেও কোনো দলীয় প্রতীকের ব্যবহার নেই। আর সেখানে বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ আরো কিছু দল অংশ না নেওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী দাঁড়িয়ে গেছে। কোথাও কোথাও মহাজোটের কয়েকটি শরিক দল অবশ্য অংশ নিচ্ছে।

বলা হচ্ছে, নির্বাচনটিতে ২০১৪ সালে দেশে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদে যেমন ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিল, এখানেও ঠিক ২২টি জেলায় চেয়ারম্যান এবং শতাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন, যা অনেকটা অগণতান্ত্রিক। কিন্তু এ ব্যাপারে যে পর্যবেক্ষকদের মত হলো, যদি কোনো দল ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচন বর্জন করে, তবে তো সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখার স্বার্থেই নির্বাচনটি করতে হয়। আর তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে ভোটার সংখ্যা কম হওয়ায় টাকা দিয়ে ভোট কেনার যে খবরটি বেরিয়েছে, সেটি রোধ করতে না পারলে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি টাকাওয়ালাদের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে। আর এ নির্বাচন বর্তমানে দেশের নির্বাচন কমিশনের মেয়াদের শেষ নির্বাচন হিসেবে তারা সেটি সঠিকভাবে করার চেষ্ট করছে।

যদিও তারা বলে আসছে, কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশনের একার নয়। অন্যদিকে সরকার ও জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকেও নির্বাচনের আচরণবিধি না ভাঙার জন্য দফায় দফায় নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। তবে যাই হোক না কেন, আজকের এই নির্বাচন যেন নাসিক নির্বাচনের মতোই আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারে, সেটাই সবার প্রত্যাশা। 

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।