ক্ষতময় ২০১৬

দর্পণ হাতে এনটিভি অনলাইন

Looks like you've blocked notifications!

এনটিভি অনলাইনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা নেওয়া হবে। আমি তাতে কাজ করতে আগ্রহী কি না? এই প্রশ্নটা আমাকে যেদিন করা হয়, তার পরের দিন ছিল তৃতীয় বর্ষের ফাইনালের শেষ কোর্সের পরীক্ষা। সন্ধ্যার সময় এই প্রস্তাব শোনার পর আনন্দে আমি আর সেই রাতে কিছুই পড়তে পারিনি। স্বাভাবিকভাবেই সব বিষয়ের মধ্যে ওটাতেই আমি সবচেয়ে খারাপ ফল করি। কিন্তু তাতে আমার তখনো আক্ষেপ ছিল না, এখনো নেই। কারণ এই চাকরিটা আমার কাছে এতটাই প্রয়োজন ছিল যে, আকাশের চাঁদ হাতে পেলেও এর চেয়ে বেশি খুশি হতে পারতাম না।

বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে আমার ভালো লাগত না। অনেক সময় অপরাধবোধ কাজ করত। ভাবতাম, আমাকে এই টাকা দেওয়া না লাগলে তারা হয়তো কিছু সময়ের জন্য হলেও অমানুষিক পরিশ্রম থেকে মুক্তি পেত।

কিছুটা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা তৈরি হলেও ২০১৬ সালটা আমার জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক ছিল না; শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, অন্যদের ক্ষেত্রেও ছিল অস্বস্তির তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সংবাদকর্মী হওয়ায় অস্বস্তির কারণগুলো খুব বেশি কাছ থেকে দেখতে হয়েছে, মুখোমুখি হতে হয়েছে। ভয়ংকরভাবে গলা কেটে হত্যা করা শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর লাশ দেখতে হয়েছে। দেখতে হয়েছে ড্রেনে পড়ে থাকা বিভাগের ছোট ভাই মোতালেব হোসেন লিপুর নগ্ন মৃতদেহ। রেজাউল করিমের ক্ষেত্রে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কথা বললেও লিপুর ক্ষেত্রে কারো কথাই বলছে না প্রশাসন। এ ঘটনার বিচার তো দূরের কথা, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে এটুকু অন্তত বলা যায়, বিচার হবে এমন স্বপ্ন দেখাটাই দুঃস্বপ্ন। এই ঘটনা তো কয়েকশ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। পুরো দেশে এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে, ঘটেছে বিদেশি-দর্জি-পুরোহিত-শিক্ষক-ব্লগার-জঙ্গি হত্যা। এসবের কোনো কিছুরই সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার বা সুরাহা করতে পারেনি রাষ্ট্র। তাই বছরের পুরোটা সময়জুড়ে সাধারণ মানুষকে থাকতে হয়েছে আতঙ্কের মধ্যে, ভয়ের মধ্যে।

এনটিভি অনলাইনে কাজের সুবাদে এ রকম অসংখ্য ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। কারণ ক্যাম্পাসের সচেতন শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মীরা এসব ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন, বিক্ষোভ করেছে; আমাকে করতে হয়েছে সেসবের সংবাদ। আর সেই সংবাদ করতে গিয়ে দেখেছি, সবকিছু কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। মানববন্ধন, বিক্ষোভ করতে হয় তাই করছে, ভেতর থেকে কেউ কিছু ধারণ করছে না। তাই হয়তো কয়দিন গেলেই আন্দোলন-মানববন্ধন শেষ। একটা ইস্যু শেষ হতে না হতেই এসে যায় নতুন কোনো ইস্যু। আবার সেটা নিয়ে কয়েকদিন মাতামাতি। আর একটার পর একটা অন্যায়-অত্যাচার-সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকলে কেনই বা এসব সাধারণের মতো শিক্ষার্থীদের গা সওয়া হবে না। তবে বিষয়টা যে গা সওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, হয়তো সে রকম না।

 

সংবাদ করতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপসাংবাদিকতার চর্চা দেখেছি, দেখেছি একই সংবাদ ই-মেইলে সবাইকে দিয়ে দেওয়া। এটা যে শুধু রাবি ক্যাম্পাসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, বিষয়টা এ রকম নয়। প্রায় সব জায়গাতেই এই প্রবণতা লক্ষণীয়। অফিসের আন্তরিক-কঠোর অবস্থানের কারণে ‘সিসি সাংবাদিকতা’ (প্রাপ্ত ইমেইল) থেকে নিজেকে অনেকটাই বের করতে আনতে পেরেছি বলেই বিশ্বাস। সাংবাদিকতা জীবনে আমার জন্য এটা বড় একটা শিক্ষাও বটে। আর সংবাদ করতে গিয়ে অনেক জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়, অনেকের ক্ষোভের শিকার হতে হয়। সেসব ক্ষেত্রে সব সময় সব  প্রয়োজনে সবাইকে পেয়েছি সেটা হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ, দেখেছি ‘বাস্তবের’ আড়ালে থাকা সত্যকে বের না করেই রাগের মাথায় হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা। তারপরও অফিসকে পাশে পেয়েছি। কারণ হয়তো ধীরস্থিরচিত্তে সিদ্ধান্ত নিতেও দেখেছি।

এনটিভি অনলাইনের একটি বিষয়ের প্রতি আমি বরাবরই মুগ্ধ। সেটা হলো সম্মান দিয়ে কথা বলার প্রবণতা। এ পর্যন্ত যতবারই আমি কাজের প্রয়োজনে অফিসে কথা বলেছি কিংবা তাঁরা বলেছেন, সম্বোধনের ক্ষেত্রে অফিস আন্তরিক ছিল। বর্তমান সময়ে এই সম্মান দিয়ে কথা বলার প্রবণতা খুঁজে পাওয়া বড়ই দুষ্কর। বয়সে বড় হলে ছোটদের ক্ষেত্রে সম্বোধনে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেসব শব্দে ‘আপন বা ঘনিষ্ঠের’ আড়ালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করে আধিপত্য। সম্মান-পদমর্যাদা-অর্থবিত্তে বড় হলে সেখানেও সম্বোধনেই থাকে আধিপত্যের সুর। এসবের চর্চা যে সব সময় সচেতনভাবে চলে বিষয়টা এ রকম নয়, কিন্তু চর্চা চলে। যার দরুন কাউকে ছোট করতে, অসম্মান করে কথা বলতে মানুষ খুব কমই ভাবে। যার ব্যতিক্রম এনটিভি অনলাইনে আমি দেখেছি। প্রত্যাশা থাকবে, চর্চাটা অব্যাহত থাকুক এবং ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।

আজকে ২০১৬ সাল বিদায় নেবে, আসবে ২০১৭। তবে খুব অল্প সময়ে যাত্রা শুরু করা এনটিভি অনলাইনের জন্য বিদায়ী বছরটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম সারির দিকে অবস্থান করছে এনটিভি অনলাইন। অ্যালেক্সা র‍্যাংকিংয়ে এনটিভি অনলাইনের এই উত্থান হয়তো বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষতগুলো ভালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে। প্রত্যাশা থাকবে, নতুন বছরে সব ধরনের সেন্সরের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিষ্ঠানটি যেন সংবাদ পরিবেশন করতে পারে।  

 

লেখক : প্রতিনিধি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়