শীতে বাঙালির ঐতিহ্য মৌসুমি বাহারি পিঠা
আমাদের দেশের কিছু ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে শীতের ঐতিহ্যবাহী নানা রকমের পিঠা। তার মধ্যে অন্যতম হলো কলা পিঠা। সারা দেশেই বড় বড় বিচিকলা নামের এক ধরনের কলা পাওয়া যায়। শীতের কলা পিঠা বানানোর জন্য এ বিশেষ জাতের কলা খুবই উপযোগী। শীতের রাতে আমাদের গ্রামাঞ্চলের মা-চাচিরা এসব কলা পিঠা তৈরি করে রেখে দিতেন। পরে সারা রাতে ঠান্ডা হয়ে সকালে জমাট বেঁধে থাকলে সেটি চামচ দিয়ে কেটে কেটে খাওয়াই হয় এর আসল ও অকৃত্রিম মজা। ঠিক একই রকমভাবে তৈরি হয় দুধচিতই পিঠা। সেটিও রাতে তৈরি করে সারা রাত জমিয়ে রেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা খেয়ে, দৌড়ে স্কুলে চলে যাওয়া—এখনো ভোলা কঠিন। সেসব মিষ্টি পিঠা তৈরিতে সাধারণত আখের গুড়, চিনি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
তবে এসব মিষ্টি জিনিসের পরিবর্তে যদি সেখানে খেজুরের রস দেওয়া যায়, তবে তো কথাই নেই। এতে যেন স্বাদ আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। সমস্যা হলো, দেশের সব জায়গায় আবার খেজুরের রস পাওয়া যায় না। খেজুরের রসের জন্য বিখ্যাত এলাকা হলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলা, যেমন—বৃহত্তর ফরিদপুর, বৃহত্তর যশোর, বৃহত্তর বরিশাল ও বৃহত্তর খুলনা। অন্যদিকে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো হলো—পাবনা, দিনাজপুর ও রাজশাহী প্রভৃতি। সেসব স্থানে খেজুরের রসের পাশাপাশি তালের রসও পাওয়া যায়। যশোরের ‘খাজুরা’ নামক একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে খেজুরের গুড়ের জন্য বিখ্যাত। যশোর-মাগুরা মহাসড়কের মাঝামাঝি স্থানে খাজুরায় এই খেজুরের গুড়ের ‘পাটালি’ হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে। এসব এলাকায় খেজুর ও তালের রসে তৈরি হয় বিশেষ ধরনের তালের রসের গুড়, তালমিশ্রি, পিঠা-পুলি, পায়েস ইত্যাদি। নতুন বছরের ফসল ওঠার পর যেমন শুরু হয় নবান্নের পিঠা উৎসব, ঠিক তেমনি শীতকালে নানা রকম বাহারি পিঠার জন্য শুরু হয়ে যায় শীতের পিঠা উৎসব। এটি উৎসবের আমেজে কখনো কখনো পিঠামেলা হিসেবেও প্রদর্শিত হয়। সারা দেশে একেক পিঠার একেক নাম হলেও তার মধ্যে কয়েকটির নাম হলো—জামাই বাবু পিঠা, বিবিখানা পিঠা, গোলাপ পিঠা, হলুদ গাঁদা, পৌষ পিঠা, সাতভাই চম্পা, কুড়ি পিঠা, নকশি পিঠা, কামরাঙ্গা পিঠা, ফুলঝুড়ি পিঠা, পটল পিঠা, বকুল পিঠা, হৃদয়হরণ পিঠা, রস চিতই পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, লাভ পিঠা, তিলা পিঠা, পাকোয়ান পিঠা, আখিয়া, গোলাপ পানতোয়া পিঠা, কিমা কুশলী, মাওয়া, দুধপুলি, তালের বড়া, প্রজাপতি পিঠা, মালপোয়া পিঠা, কিছুমিছু পিঠা, মুড় গোলাপ পিঠা, পুলিং, নারকেল পুলি, মুগবেনী, ভাঁপা পিঠা, গুলবাহার, সবজিবাহার পিঠা, ঝাল পাকোয়ান, আন্দশা পিঠা, ক্যারোট কুইন পিঠা, কিমা পাটিসাপটা, মাওয়া পাটিসাপটা, ক্ষীর পাটিসাপটা, নারকেল পাটিসাপটা ইত্যাদি। এসব পিঠাই সারা দেশে ঘুরেফিরে তৈরি করা হয়। তবে সময় ও স্থানভেদে এসব পিঠার ভিন্ন ভিন্ন নামও রয়েছে। কিন্তু গ্রামবাংলার এসব ঐতিহ্যবাহী শীতের পিঠাতে কোনো ভেজাল নেই, তবে তাদের উপকরণে রয়ে রয়েছে ভেজাল। কারণ তেল, মিষ্টি, গুড় ইত্যাদিতে দেওয়া হয় ভেজাল। এখন বাজারে গেলে প্রচুর পরিমাণে খেজুরের গুড় দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ খেজুরের গুড় তৈরি হওয়ার মতো আয়োজন এখন আর আমাদের দেশে নেই। তার মানে হলো, এগুলো ভেজাল দিয়ে বেশি দামের আশায় আখের গুড় কিংবা চিনিকে বিশেষ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে খেজুরের গুড় হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে। কাজেই কোনো ভেজালের কাছে যেন বাঙালির ঐতিহ্যের শীতের পিঠা হারিয়ে যেতে না পারে, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নজর রাখতে হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।