স্মরণ

জিয়াউর রহমান ও উত্তরাধিকারের দায়

Looks like you've blocked notifications!

মহান নেতাদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে থাকে। ‘মহান’ শব্দটির শেকসপিয়ারের আদলে ব্যাখ্যা করলে এ রকম দাঁড়ায়—১. কেউ কেউ মহত্ত্ব নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন, ২. কারো কারো প্রতি মহত্ত্ব আরোপ করা হয়, ৩. আবার কেউ কেউ তাঁর কর্মের দ্বারা মহত্ত্ব অর্জন করেন। বাংলাদেশের নেতানেত্রীদের এই তিন বিভাজনে বিভক্ত করা যায়। জিয়াউর রহমান এই বিভাজনে শেষোক্ত পর্যায়ভুক্ত। তিনি রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করেন না। কেউ তাঁর প্রতি মহত্ত্ব আরোপ করেনি। তিনি স্বমহিমায় মহিমান্বিত। জিয়াউর রহমানের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি জীবনের কোনো অধ্যায়ে রাজনৈতিক নেতা হওয়ার বাসনা পোষণ করেননি। তিনি পেশা হিসেবে পছন্দ করেছিলেন সামরিক বাহিনী। তাঁর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা সাধারণ শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সম্পাদন করেন।

কলকাতা হেয়ার স্কুল, করাচির তাইয়েব আভি একাডেমি এবং ডি. জে. কলেজ অভিজাত প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাঁর জন্ম যেমন মধ্যবিত্ত পরিবারে, তেমনি পড়াশোনার প্রতিষ্ঠানগুলোও ছিল মধ্যবিত্ত মাত্রার। এসব বিষয় সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, শিশু-কিশোরের মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিয়াউর রহমানকে যদি ‘এইম ইন লাইফ’ বা জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে রচনা দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয় তিনি ‘সৈনিক’ হতে চেয়েছিলেন। এ চাওয়ার মধ্যে মধ্যবিত্ত মানসিকতার স্ফুরণ রয়েছে।

উপনিবেশিক শাসনের প্রান্তিক পর্যায়ে তিনি ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন যখন, সাম্রাজ্যবাদমুক্ত হতে চলেছে স্বদেশ। ১৯৫২ সালে একটি বাঙালি পরিবারের তরফ থেকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ঘটনা এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস বলে চিহ্নিত হতে বাধ্য। আমরা যতটা জানি, পরিবার তাঁকে আর্মি অফিসার হওয়ার জন্য বাধ্য করেনি, বরং সেটি ছিল তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। নিঃসন্দেহে ওই সময়ের একজন যুবকের জন্য এটি ছিল অগ্রসর চিন্তা। তিনি শুধু সেনাবাহিনীতে যোগদান করে গতানুগতিক পেশা অবলম্বন করেননি। ১৯৬৫ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হয়তো সে কারণেই ১৯৬৬ সালে কোয়েটার সামরিক একাডেমির প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৬৯ সাল থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগপর্যন্ত তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক বাহিনীতে তিনি পূর্ব-পশ্চিম বিভেদ প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর লেখালেখি এবং অন্যদের স্মৃতিকথায় এসব ঘটনা উঠে এসেছে। তিনি বাঙালিদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণে ছিলেন রুষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকালে তিনি আর সব সেনা কর্মকর্তার মতো প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

১৯৭১ সালের ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নির্মমতার পর তিনি বসে থাকেননি। প্রথম সুযোগেই উচ্চারণ করেছেন, ‘উই রিভোল্ট।’ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতা, দোদুল্যমানতা এবং পলায়নপর অবস্থায় একটি কঠিন, অভাবিত এবং অসম্ভব সাহসী একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এটি তাঁর প্রতি কোনো আরোপিত দায়িত্ব ছিল না। কারো অনুরোধে তিনি এ সিদ্ধান্ত নেননি। ঘটনাটি তাৎক্ষণিক, তবে তাৎপর্যপূর্ণ। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এবং পারিবারিক জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, খালেদা জিয়া দুই শিশুপুত্রসহ তখন ঢাকায় অন্তরীণ ছিলেন; স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজ কৃতিত্ব জাহির করেননি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছেন। পরবর্তীকালে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদান স্বীকৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর ভূমিকা যখন অবমূল্যায়িত হয়েছে, তখন তিনি বিনা প্রতিবাদে তা-ও মেনে নিয়েছেন।

১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাবলিতে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। কর্নেল সাফায়াত জামিলসহ কোনো সেনা কর্মকর্তা এর বিপরীত সাক্ষ্য দেননি। সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল নিয়মতান্ত্রিক। ঘটনাপরম্পরা তাঁকে দেশের কর্ণধারে বরণ করেছে। তিনি কখনোই পদমর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা এবং ক্ষমতার জন্য লালায়িত ছিলেন না। 

জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালে তাঁর মৃত্যুর আগপর্যন্ত বাংলাদেশে জাতি-রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন। তিনি আদর্শ ও লক্ষ্যহীন জাতিকে দিয়েছেন অবিনশ্বর নির্দেশনা। তিনি আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা স্থাপন করেছেন। ইসলামী মূল্যবোধের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি করেছেন। রাজনৈতিক দল গঠনে ‘ডানের বাম অংশ এবং বামের ডান অংশ’ নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি তাঁর জাতিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে ‘পরিপূর্ণ ঝুড়ি’তে পরিণত করেছেন। উন্নয়ন কৌশলের এমন সব মৌলিকত্ব- ব্যক্তিবিনিয়োগ, মানবসম্পদ রপ্তানি এবং পোশাকশিল্পে ইত্যাদির সূচনা করেন, যা যথার্থভাবে তাঁকে ‘আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি’তে অভিষিক্ত করেছে। তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন একটি অলস, অস্থির, অরাজক জাতিকে স্বকর্ম মহিমায় উদ্দীপ্তকরণ। জাতিকে বহির্বিশ্বে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি তাঁর যাপিত জীবনে সততা, সরলতা, সহজতা এবং সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নিজে দুর্নীতিমুক্ত ছিলেন। দল ও রাষ্ট্র কাঠামোকে তাঁর ভাষায় ‘খাই খাই রব’ থেকে রক্ষা করেছেন। গ্রামবাংলার দোরগোড়ায় শত শত মাইল নিজেকে পৌঁছে দিয়ে ‘রাজনীতিকে কঠিন’ করার ব্রত নিয়েছেন।
বহুদলীয় গণতন্ত্র শুধু পুনরুজ্জীবিতই হয়নি, বরং সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগত জীবনাচার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রী ছিলেন। তিনি ‘আমিত্ব’ আকীর্ণ ছিলেন না। ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এ নীতিতে তিনি আস্থাশীল ছিলেন। মানুষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস এতটাই প্রবল ছিল যে জীবনের শেষ যাত্রায় সকলে তাঁকে সতর্ক করলেও তিনি ছিলেন বন্ধুত্বের আস্থায় অবিচল। তিনি তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার, মরণ বাংলাদেশ’। জিয়াউর রহমান বেঁচে নেই। জিয়াউর রহমানের আদর্শ চির অম্লান। প্রতিটি স্মরণ, প্রতিটি জন্মবার্ষিকী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, জিয়া আছে দেশজুড়িয়া’। যেকোনো স্মরণ বা অনুষ্ঠান নিষ্ফল হয় তখনই, যখন নেতাকর্মীরা শুধুই আত্মবাক্য রচনা করে; বড় বড় বক্তৃতা দেয়। বড় বড় লেখা লেখে। অথচ ব্যক্তিজীবনে জিয়াউর রহমানের জীবনাদর্শ অনুসরণ করে না। 

এখানেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। অনেকে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সে কারণে নেতার সন্তান নেতা-নেত্রী হয়। পৃথিবীর সর্বত্র একই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ঠিক এ সময়ে দক্ষিণ এশিয়া উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব সমর্পিত। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মিয়ানমারে জাতীয়তাবাদী নেতা উনুর কন্যা অং সাং সু চির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতে গান্ধী-নেহরুর উত্তরাধিকারের রাজনীতি এখনো উজ্জ্বল। পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বংশধারার রাজনীতি এতটাই প্রকট যে পিতা আসিফ আলী জারদারি তাঁর পুত্র ‘একরকম বালক’ বিলাওয়াল ভুট্টোকে পিপিপির দলীয় প্রধান করতে বাধ্য হয়েছেন। সিংহলে বন্দরনায়েকের নামে এখনো জয়জয়কার শোনা যায়। এসব উত্তরাধিকারের তাৎপর্য কি এই যে যাঁরা রক্তের উত্তরাধিকার বহন করেন বংশপরম্পরায়, তাঁরাই নেতা-নেত্রীর উত্তরাধিকারী? বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের সে সক্ষমতার প্রমাণ আছে। খালেদা জিয়া যখন গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে অবতীর্ণ হলেন, তখন অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর নেতৃত্ব সম্পর্কে। তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকারের পতাকা সমুন্নত করেছেন। সফলভাবে দেশ পরিচালনা করে জনগণের অকুণ্ঠ আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন।

রাজনৈতিক উত্তরাধিকার যদি ব্যক্তিক ও বস্তুবাদী হয় বা যদি উত্তরাধিকারকে ধারণ করার কেউ না থাকে, তাহলে উত্তরাধিকার রক্ষা করা সম্ভব হয় না। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী এবং মহাত্মা গান্ধীর রক্তের উত্তরাধিকার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও প্রগাঢ় ভালোবাসা নেতা-নেত্রীকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখে। বাংলাদেশের সচেতন মানুষের কাছে তাঁদের প্রিয় ‘হক সাহেব’ এখনো অপার আবেগের মানুষ। ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসেবে সোহরাওয়ার্দী আজও শ্রদ্ধেয়। মেহনতি মানুষের ‘মজলুম জননেতা’ ভাসানী শোষণমুক্তির বিরুদ্ধে আজও প্রেরণার উৎস। আশার কথা, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তাঁদের মেধা-মনন, শ্রম-সময় এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে কোটি কোটি মানুষের আত্মজাগৃতির সংগ্রামে এখনো সমুজ্জ্বল। একজন সন্তানহারা ও সন্তান বিচ্ছিন্ন মা, স্বামীহারা নারী এবং নিরন্তর নির্যাতনের মধ্যে বসবাসকারী নেত্রী যে সাহস, সংকল্প এবং দৃঢ়তা নিয়ে গোটা জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তা অভাবনীয়। সে ক্ষেত্রে গোটা জনগণ তাঁর সহচর নেতা-নেত্রীদের থেকে আরো সহযোগিতা আশা করে। এটি একটি নির্মম সত্য যে, জাতীয়তাবাদী শক্তি রাষ্ট্রীয় নির্মম শক্তি প্রয়োগের মধ্যে দিনাদিপাত করছে। তার পরও সব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে নেতাকর্মীরা শহীদ জিয়ার উত্তরাধিকারের দায় গ্রহণ করবেন—গণতন্ত্রের স্বার্থে এটাই কাম্য। সব স্বার্থ-সুবিধার দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিবিদ্বেষ, দলীয় দ্বন্দ্ব-কলহ, সুবিধাবাদ, নির্লিপ্ততা, নিষ্ক্রিয়তা, লোভ ও লালসা অতিক্রম করে শহীদ জিয়ার আদর্শের উত্তরাধিকারীরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকবেন—এটা আপামর জনগণের প্রত্যাশা। এ শপথ উচ্চারিত হলে তখনই কেবল জিয়াউর রহমানের ‘রক্তঋণ’ পরিশোধিত হবে। ‘শহীদ জিয়া লোকান্তরে, লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে’—এ উচ্চারণ তখনই সার্থক হবে। 

লেখক : কলামিস্ট এবং প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।