দৃষ্টিপাত

ভারতীয় সিরিয়াল ও কিছু কৌতুক

Looks like you've blocked notifications!

প্রবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে যেভাবে বিদেশি, বিশেষ করে ভারতীয় সংস্কৃতির মোড়কে বাস্তবতাবিবর্জিত কাল্পনিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টিকারী সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসন চালানো হচ্ছে, তাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময় বাকি আছে বলে মনে হয় না। যে সংস্কৃতি সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাঙালি মনন ধ্বংস করছে এবং বাংলাদেশিদের মাঝে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় তৈরি করছে, তা গ্রহণের পূর্বে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা অত্যাবশ্যক।

বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড ছাড়াও দেশে এখন চালু আছে ২৬টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। প্রতিদিনের সর্বশেষ দেশি-বিদেশি খবর ছাড়াও আমাদের চ্যানেলগুলো সিনেমা, নাটক সিরিয়াল, স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান, বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, টক শোসহ পাঠকের চাহিদা মেটানোর জন্য সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। দর্শকদের ভিন্ন ভিন্ন রুচির চাহিদা মেটাতে গিয়ে চ্যানেলগুলোর কিন্তু প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু তাতে লাভ কি উলুবনেই যেন মুক্তা ছড়ানো হচ্ছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। দর্শকদের কিন্তু ফেরানো যাচ্ছে না বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোর এই প্রচেষ্টার দিকে। তাঁরা ভারতীয় চ্যানেলগুলোর প্রতিই আসক্ত। বিশেষ করে ঘরে ঘরে নারীরা যেন মাদকের মতো আসক্ত হয়ে পড়েছেন ভারতীয় চ্যানেলের প্রতি। এর কুপ্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সমাজ সভ্যতার ওপর।

ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, কোনো প্রতিষেধকই এখন আর কাজ করছে না। অভিজাত শ্রেণি থেকে শুরু করে একেবারেই পতিত শ্রেণি, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবার, বয়স্ক থেকে শিশু পর্যন্ত সবাই এই মহাব্যাধিতে নিমজ্জিত। আমাদের বাচ্চারা এখন মায়ের ভাষা বাংলা শেখার আগেই হিন্দিতে কথা বলা রপ্ত করে ফেলছে। আর এটি হচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কারণে। আর এসব দেখে তারাও ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিপরীত ধারায়।

ভারতের বাংলা চ্যানেল জি বাংলা, স্টার জলসা, ইটিভি, হিন্দি চ্যানেল জিটিভি ও স্টার প্লাস সর্বাধিক সিরিয়াল প্রচার করে থাকে। এগুলোর সবই বাংলাদেশে জনপ্রিয়। একটু লক্ষ করলেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে এসব সিরিয়ালের বিষয়বস্তু হলো ‘পরকীয়া’। এক নারীর সঙ্গে একাধিক পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক, বিবাহবহির্ভূত মেলামেশা, আবার এক পুরুষের সঙ্গে একাধিক নারীর দৈহিক সম্পর্ক ও মেলামেশাকে কেন্দ্র করে কাহিনী আবর্তিত হয় ভারতের চ্যানেলগুলোর টিভি সিরিয়ালে। এগুলোকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিবর্তে সৃষ্টি হয় সন্দেহের। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে সন্দেহ করে। ফলে সুখের সংসারে আগুন লাগে। কখনো কখনো নতুন বউ ঘরে আসতে না আসতেই এই সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে।

মাতালের মতো আগ্রহ নিয়ে এসব সিরিয়ালের কাহিনী পর্যবেক্ষণের কারণে আমাদের সমাজেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। স্বামী সকালে বাসা থেকে বের হয়ে সারা দিন কী করে, সে কি চাকরি করে, না প্রেম করে, না আরেক বিবির কাছে সময় কাটিয়ে আসে, অফিসে কি সে তার কোনো নারী কলিগের সঙ্গে কোনো অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে কি না, এমন সন্দেহ ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে এই টিভি সিরিয়ালের বদৌলতে। একইভাবে উল্টো সন্দেহের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক স্বামীর মাঝে। কারণ তিনি থাকেন সারা দিন বাইরে, ঘরে একা নারী অন্য কারো সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে।

এভাবে একপর্যায়ে এসব বাস্তবে আমাদের মনেও দাগ কাটে, নিজেদের প্রবৃত্তিটাও আস্তে আস্তে সেভাবেই বিকশিত হয়। তাদের ভেতরের স্বভাবটাও আস্তে আস্তে ঝগড়াটে স্বভাবে রূপ নেয়। এটা যখন বাস্তবে রূপ লাভ করে, তখন পরিবারগুলোতেও দেখা দেয় প্রতিহিংসা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও ঝগড়াটে পরিস্থিতি। এরূপ প্রতিহিংসার জন্ম হয় মা-বেটির মধ্যে, বোনে-বোনে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, বাপ-বেটায়, স্বামী-স্ত্রীতে, বউ-শাশুড়িতে, বউ-ননদসহ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের। সংসারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, পরকীয়া বাড়ছেই। পাশাপাশি মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

তাহলে ফলাফলটা কী? মানুষ-মানুষে, পরিবারের প্রতি সদস্যের প্রতি পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, মহব্বতের মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা এবং শান্তির আবাসস্থল। বিশ্বাস না থাকলে বাস্তবে পৃথিবীতে কোনো সভ্যতাই গড়ে উঠত না। সেই বিশ্বাস যেন ভেঙে দিতে চাইছে সিরিয়ালগুলো।

সব মিলিয়ে বলব, ভারতীয় চ্যানেলগুলো আমাদের ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছু করছে না।

অবশ্য সমস্যা পদে পদে। এসব সিরিয়াল নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক।  কেউ বলছেন, বিশ্বায়নের এই যুগে নিজেকে গুটিয়ে রাখার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি অন্য দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ারও সুযোগ নেই। তা ছাড়া তাদের কাছে আরো যুক্তি আছে, বাংলাদেশের চ্যানেলে ৪০ মিনিটের নাটকে এক ঘণ্টার বিজ্ঞাপন, আমাদের টেলিভিশনগুলো যদি ভালো মানের সিরিয়াল তৈরি করত, তবে কেউ আর ভারতীয় সিরিয়াল দেখত না। খোঁড়া যুক্তি আর কাকে বলে! বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে অভিযোগ হয়তো অনেকাংশে ঠিক, মেনে নিলাম। তবে সত্যি কি আমাদের মিডিয়া ভালো কিছু দিতে পারছে না বলে এসব ভারতীয় সিরিয়ালের আসক্তি কাটছে না। কিন্তু মনে রাখা জরুরি, যেকোনো মন্দ জিনিসেই আসক্তি বা নেশা হয়।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করার মাধ্যমে এক দেশের পণ্য যেমন অন্য দেশে বিনা বাধায় প্রবেশ করছে, তেমনি সংস্কৃতিও  মুক্তবাজারের কল্যাণে ভারতীয় স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলা, জিটিভি, স্টার ওয়ান, সনি, জি স্মাইল, ইটিভিসহ ভারতের ডজন তিনেক চ্যানেল আমাদের দেশে দেখানো হচ্ছে। বিটিভিসহ আমাদের দেশেরও প্রায় ৩২টি টিভি চ্যানেল রয়েছে। অথচ এর একটিও ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যেই সম্প্রচারিত হয় না। ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেল প্রচারিত না হওয়ার জন্য কি আমাদের টিভি অনুষ্ঠানের নিম্নমান দায়ী? অবশ্যই না। আমাদের দেশের টিভিতে যেসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, তা শুধু গতানুগতিক সংস্কৃতির চর্চাই নয়, বরং শিক্ষামূলকও। তবুও ভারতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার না হওয়ার অন্যতম কারণ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর অগাধ-প্রবল শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু আমাদের দেশে ভারতীয় চ্যানেলের কোনো লাগাম নেই। এভাবে আকাশ খুলে দিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে নীরবে তার মহামারীর রূপ ধারণ করতে দেওয়ার মতো দুর্ভাগা জাতি আর আছে কি না তা জানা নেই।

সিরিয়াস কথা তো অনেক হলো। এবার একটু হাসি-তামাশা করি। আপনাদের শোনাচ্ছি কিছু সিরিয়াল-সংক্রান্ত বাস্তবিক কৌতুক। ইতিহাসের শিক্ষক ছাত্রকে প্রশ্ন করেছেন, নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়েছিলেন কেন? ছাত্রের উত্তর, সিরিয়ালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি চাঁদে ভ্রমণ করেন। এ তো গেল ইতিহাসের ক্লাস। ফিজিক্স ক্লাসে শিক্ষক প্রশ্ন করলেন, এলিয়েনরা কেন পৃথিবীতে আসছে না? ছাত্র হেসে উত্তর দেয়, এলিয়েনরা ভুলে সিরিয়ালের সার্ভার হ্যাক করে এবং সিরিয়াল দেখে ফেলে। এরপর আর তারা পৃথিবীমুখী হয়নি। শিক্ষক রেগে গিয়ে বলেন, এ সিরিয়াল কেন শেষ হচ্ছে না? (হয়তো ঘরেও তিনি সিরিয়ালের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ছিলেন)? ছাত্র উত্তর দেয়, স্যার শেষ হবে কী করে?  ছেলেটি মেয়েটিকে দেখছিল, মেয়েটি ছেলেটিকে দেখছিল। সিরিয়াল চলছিল। পদ্মা গিয়ে যমুনায় মেশে। যমুনায় চর পড়ে। নদী শুকায়। কিন্তু সিরিয়াল চলতেই থাকে। এভাবেই হাজারখানেক পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল। বুঝুন তাহলে অবস্থা।  

এবারে একটি সিরিয়াস কৌতুকে আসি। একদল ডাকাত জামিনের জন্য জজের বউকে ঘুষ দিতে জজের বাসায় গেছে। এ সময় দলের অন্য অপরাধী সরদারকে বলল, সরদার জামিন দেবে জজ সাহেব, আমরা তার বউয়ের কাছে কেন এলাম। সরদার মুচকি হেসে খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে, কারণ জজ সাহেবকে বাসায় ফিরতেই হবে।

 লেখক :  শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।