বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে মার্কিন পরিবর্তনের প্রভাব

Looks like you've blocked notifications!

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একক বৈশ্বিক ব্যবস্থা দ্বারা পৃথিবী পরিচালিত। সিনিয়র বুশ ১৯৯০ সালে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ নামে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানান। সেই সহযোগিতার বিষয়টি পরবর্তীকালে কতিপয় আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়। সেই থেকে গোটা বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়টিতে দেশটির আগ্রাসনের নমুনা যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি বিশ্বায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়-বাণিজ্য, তথ্য ও প্রযুক্তি বিপ্লব, বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়ে প্রাধান্য অর্জন করে। মার্কিন পুঁজি সম্প্রসারিত হয় সব ক্ষেত্রে সব দেশে। ১৯৯০ থেকে ২০১৬—এই সিকি শতাব্দীতে ক্রমে মার্কিন পরাক্রম প্রদর্শিত হলেও অভ্যন্তরীণ মার্কিন বিনিয়োগ এবং সেবাক্ষেত্র অবহেলিত হয়।

মার্কিন করপোরেটিজমের বিরুদ্ধে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে বনেদি মার্কিন মানস। ২০১৬ সালে নভেম্বর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় রিপাবলিকার প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন জনগণের এ নীরব ক্ষোভকে সরব করে তোলেন। তিনি ‘মার্কিন রক্ষণশীলতাবাদ’-এর পুনরুজ্জীবন ঘটান। পরিশীলিত মার্কিন সংস্কৃতিতে খুব তীব্রভাবে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়নি। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ধনকুবের ধনীদের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি গতানুগতিক রাজনীতিকে রীতিমতো ধাক্কা দেন। সুবিধাবঞ্চিত, বেকার, অভিবাসী যন্ত্রণায় ক্ষুব্ধ এবং ক্রমাগত সন্ত্রাসবাদের দ্বারা আক্রান্ত মার্কিন জনগণ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ট্রাম্পকে জিতিয়ে দেয়। মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থার কুশলতায় হিলারি ক্লিনটন জনপ্রিয় ভোটে এগিয়ে থাকলেও সাংবিধানিক ভোটে পরাজয় বরণ করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন স্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীকে আন্দোলিত করে। তার কারণ, বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের একক কর্তৃত্ব। এবারের নির্বাচন বিশ্বকে শুধু আলোড়িতই করেনি, বিস্মিত করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যেভাবে ইউরোপ, আমেরিকার নিরঙ্কুশ ‘রাজত্ব’ চলছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তা হোঁচট খেয়েছে। প্রথমত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া—ব্রেক্সিট, দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় তথা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ‘নতুন জার’ কথিত ভ্লাদিমির পুতিনের পুনরুত্থান এবং অবশেষে মার্কিন মুলুকে রক্ষণশীল নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা—পৃথিবীকে একটি পালাবদলের সংবাদ দিচ্ছে।

বাংলাদেশ এই পালাবদলের কুশীলব না হলেও আমরা যেহেতু এই পৃথিবীতে বসবাস করি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ আমাদের প্রভাবিত করে, তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের পালাবাদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে দেশের চেয়ে বিদেশ অনেক প্রভাবশীল। এ দেশে যা-ই ঘটুক না কেন, তারা স্নায়ুযুদ্ধ সময়কালে রুশ-মার্কিন সমীকরণ দ্বারা তা নির্ণয় করত। পাতলা খান লেনে যদি একটি পটকা ফুটত, তাহলে তারা বলাবলি করত, এটা সিআইএ নতুবা কেজেবি ঘটিয়েছে। এখন তারা ভালো-মন্দের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকায়। ট্রাম্প হিলারির নির্বাচন নিয়ে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দল দুটির অতি আগ্রহের কথা সকলেরই জানা। একদল মনে করেছে, হিলারি জিতলে তাদের জিত, আরেকদল মনে করেছে হিলারি না জিতলে তাদের জিত। মজার ব্যাপার, ট্রাম্পকে নিয়ে দুদলের কোনো অনুরাগ বা বিরাগ ছিল না।

হিলারি জিতলে বাংলাদেশের বিষয়টি হয়তো প্রাধান্য পেত। কেননা, তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বিশেষ বন্ধুত্বের বাইরে বাংলাদেশের মানুষের তার একটি সম্প্রীতি লক্ষ করা গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের বিষয়াদি তার কাছে চেনাজানা ছিল। অন্যদিকে ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ এক অচেনা-অজানা দেশ। এমনও হতে পারে তিনি বাংলাদেশ চেনেন না। হাস্যকর হলেও সত্য যে, চিত্রনায়ক থেকে রাষ্ট্রনায়ক রোনাল্ড রিগ্যান একবার জিজ্ঞেসা করেছিলেন, শ্রীলঙ্কা কোথায়? ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো বোঝেন। ব্যবসার কারণেই তিনি হয়তো বাংলাদেশকে চেনেন। তার বৈদিশিক নীতি রক্ষণাত্মক। অর্থনৈতিক নীতি ঘরমুখো। তিনি বিশ্ব বাণিজ্যর কথা ভাবেন না। সামরিক ক্ষেত্রেও তিনি রক্ষণশীল। তিনি পৃথিবী থেকে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের প্রতিজ্ঞা করেছেন, তার অভিষেক বক্তৃতায়। কঠোরভাবে ট্রাম্প অভিবাসীবিরোধী। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। ২০২১ সাল নাগাদ মধ্য আয়ের দেশ হতে চায়। দুর্বার গতিতে না হলেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অবস্থান এমন নয় যে এটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ রণকৌশলগত বা বাণিজ্য পথে রয়েছে। চীন, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত নেই। অনেকে অনেক হিসাব-নিকাশ করে চীনের প্রয়োজনে বাংলাদেশের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক অবস্থানের কথা বলেন। যেখানে চীনের সঙ্গে ভারত-জাপানের মতো বিশাল দেশ সরাসরি সীমানার মধ্যে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের কৌশলগত স্থান কোথায়?

ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনীতি, ভূনীতি, অর্থনীতি কোনো নীতিতেই বাংলাদেশ দৃষ্টিগোচর হওয়ার নয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, বাংলাদেশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সহযোগিতা অথবা অসহযোগিতা পাওয়ার কথা নয়। নতুন প্রশাসনের যেসব ঘোষিত নীতি-কৌশলের কথা আলোচনা করা হয়েছে, তাতে ইতিবাচক বিষয়ের চেয়ে নেতিবাচক প্রাধান্য থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের রাজা বা উজির কে হলেন, তাতে মার্কিন নতুন প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই। এমনকি মার্কিন প্রশাসনের বহুল কথিত ‘তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রায়ন’ নীতির বিষয়ে ট্রাম্প আগ্রহী নয়। ইরাকে মার্কিন হস্তক্ষেপকে তিনি এ সময়ের সবচেয়ে নিন্দনীয় কাজ বলে মনে করেন। তিনি বহির্বিশ্বে মার্কিন প্রভাব-প্রতিপত্তি কমিয়ে নিজ দেশকে প্রধান্য দিতে চান। ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতি অনুযায়ী তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি সামরিক দিক দিয়ে গুটিয়ে নিতে চান। সুতরাং হস্তক্ষেপের নীতি যদি বর্জিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র স্বধীনতাকামী এবং উন্নয়ন উচ্চকাঙ্ক্ষী দেশ নিরাপদ থাকার কথা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মানুষ বিশেষত গার্মেন্টস গ্রুপ নতুন প্রশাসন শঙ্কিত। ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন বিনিয়োগকারীদের ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা করেছেন।

বাংলাদেশে পোশাকশিল্প এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক মার্কিন বিনিয়োগ রয়েছে। যদি ট্রাম্প সত্যি সত্যিই পৃথিবী থেকে হাত গুটিয়ে নিতে চান, তাহলে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ বাণিজ্য ক্ষেত্রে পোশাকশিল্প ক্ষেত্রে প্রাধান্যশীল দেশ। যদিও বাংলাদেশ ওবামা হিলারি প্রশাসনে জিএসপি পায়নি, তবুও অন্যান্য সুবিধা উদার ছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, বাংলাদেশ শিগগিরই জিএসপি সুবিধা লাভ করবে। এতে মনে হয়, সুবিধা লাভের বিষয়টি প্রান্তিক পর্যায়ে ছিল। বাণিজ্যমন্ত্রীও আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসনের তরফ থেকে রাষ্ট্রদূতদের নীতিগতভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে জিএসপি বা বাণিজ্য সুবিধার বিষয়টি নতুন করে আলাপ করতে হবে।

সরকার পরিবর্তন হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বড় রাষ্ট্রের নীতি-কৌশলের পরিবর্তন হয় না। সুতরাং আশা ও আশঙ্কার দোলায় থাকতে হবে বাংলাদেশকে। চতুর্থত, বাংলাদেশের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে একটি দুঃসংবাদ দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহে মার্কিন সহায়তা তিনি প্রত্যাহার করবেন। প্রথম একশ দিনের অগ্রাধিকার তালিকায় বিষয়টি রয়েছে। এরই মধ্যে পৃথিবীব্যাপী পরিবেশকর্মীরা এর নিন্দা করেছেন। পঞ্চমত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক এবং বৈরী অভিবাসী নীতি-কৌশল প্রয়োগ করলে লক্ষ বাংলাদেশিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে হবে। বাংলাদেশি জনশক্তির আমেরিকা অভিমুখী অভিযাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে কমে আসবে বাংলাদেশি মানুষের রেমিট্যান্স। এরই মধ্যে রেমিট্যান্স ঘাটতি ঘটেছে। কারণ, খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ষষ্ঠত, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমকে সম্ভবত ডোনাল্ড ট্রাম্প সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে মোকাবিলা করবেন। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বহুবার ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর অভিষেক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘সমগ্র বিশ্ব থেকে তিনি ইসলামী সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করবেন। বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের যে ইসলামী রূপ এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে, তা নির্মূলের জন্য যদি ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর বিরূপ হয়, তা আমাদের জন্য সর্বনাশের কারণ হবে।

পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যাঁরা অবহিত, তাঁরা জানেন জাতীয় স্বার্থই পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা। এ ক্ষেত্রে সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্র/প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোনের উক্তিটি সবাই উদ্ধৃত করেন। তার উক্তির মর্মার্থ হলো, ‘গ্রেট ব্রিটেনের চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র নেই, আছে চিরস্থায়ী স্বার্থ।’ ডোনাল্ড যখন বাংলাদেশে নতুন রাষ্ট্রদূত পাঠাবেন বা বাংলাদেশবিষয়ক নীতিনির্ধারণ করবেন, তখনো তিনি জাতীয় স্বার্থেই সিদ্ধান্ত নেবেন। বাংলাদেশ তার স্বকীয় কৌশল, কূটনীতি এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতার মাধ্যমে স্বকীয় স্বার্থ রক্ষায় সতর্ক হবেন—এটাই সাধারণ প্রত্যাশা।

লেখক : কলামিস্ট এবং প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।